এই ব্লগ পোস্টে, আমরা পদার্থবিজ্ঞান | নবম শ্রেণি | বস্তুর ওপর তাপের প্রভাব | ষষ্ঠ অধ্যায় এর কঠিন পদার্থের প্রসারণ ও এই পাঠ সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল প্রশ্ন ও এর সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।
![]() |
চিত্রঃ তাপ প্রয়োগে কঠিন পদার্থের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও আয়তন বেড়ে যায়। |
পদার্থের তাপজনিত প্রসারণ | Thermal Expansion of Material
সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সকল পদার্থই তাপ প্রয়োগে প্রসারিত হয় এবং তাপ অপসারণে সংকুচিত হয়। যখন কোনো বস্তু উত্তপ্ত হয়, তখন বস্তুটির প্রত্যেক অণুর তাপশক্তি তথা গতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। কঠিন ও তরল পদার্থের বেলায় আন্তঃআণবিক বলের বিপরীতে অণুগুলো আরো বর্ধিত শক্তিতে স্পন্দিত হতে থাকে ফলে সাম্যাবস্থা থেকে অণুগুলোর সরণ বেড়ে যায়। কিন্তু কোনো অণু এর সাম্যাবস্থা থেকে সরে যাবার সময় টান অনুভব করে। অর্থাৎ, অণুটি যখন পার্শ্ববর্তী অণুর কাছাকাছি যেতে চায় তখন বিকর্ষণ অণুভব করে। আবার আন্তঃআণবিক দূরত্ব যখন বৃদ্ধি পায় তখন আকর্ষণ অনুভব করে। বস্তুত কোনো বস্তু যখন স্থিতিস্থাপকতা ও স্থিতিশীলতা লাভ করে তা এই যুগপৎ আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বলের উপস্থিতির জন্য। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে কঠিন বস্তুর অণুগুলো যে স্পন্দিত হতে থাকে তা সরল ছন্দিত স্পন্দন নয়। এর কারণ, দুই অণুর মধ্যে দূরত্ব সাম্যাবস্থার তুলনায় যদি কমে যায় তাহলে বিকর্ষণ বল দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এদের মধ্যে দূরত্ব সাম্যাবস্থার তুলনায় বৃদ্ধি পেলে আকর্ষণ বল তত দ্রুত বৃদ্ধি পায় না। ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবার ফলে জমাট বস্তুর মধ্যে অণুগুলো যখন ছুটাছুটি করে তখন একই শক্তি নিয়ে ভিতর দিকে যতটা সরে আসতে পারে, বাইরের দিকে তার চেয়ে বেশি সরে যেতে পারে। এর ফলে প্রত্যেক অণুর গড় সাম্যাবস্থান বাইরের দিকে সরে যায় এবং বস্তুটি তাপে প্রসারণ লাভ করে। তরল পদার্থের বেলায় আন্তঃআণবিক বলের প্রভাব কম বলে তাপের কারণে এ প্রসারণ বেশি হয়। গ্যাসীয় পদার্থের বেলায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বহুমুখী চাপ বৃদ্ধি পায় বলে অণুগুলোর ছুটাছুটি বৃদ্ধি পায়। জমাট পদার্থের বেলায় আন্তঃআণবিক বলের প্রকৃতি তাপজনিত প্রসারণ নির্ধারণ করে, কিন্তু গ্যাসের বেলায় চাপ তাপের সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে চাপকে অপরিবর্তিত রাখার জন্য গ্যাসের আয়তন বৃদ্ধি পায়। গ্যাসীয় পদার্থের চেয়ে তরল পদার্থের প্রসারণ অপেক্ষাকৃত কম এবং কঠিন পদার্থের প্রসারণ হয় সবচেয়ে কম।
কঠিন পদার্থের প্রসারণ | Expansion of Solids
কঠিন পদার্থের সম্প্রসারণ একটি চমকপ্রদ ঘটনা যা আমাদের চারপাশে ঘটে, যা
দৈনন্দিন বস্তু এবং আমাদের পৃথিবীকে তৈরি করা কাঠামোকে প্রভাবিত করে। বস্তুগত
বিজ্ঞানের এই মৌলিক দিকটি প্রকৌশল থেকে শুরু করে দৈনন্দিন ব্যবহারে বিভিন্ন
ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তাপ প্রয়োগ করলে কঠিন পদার্থের প্রসারণ ঘটে এবং অপসারণ করলে এর সংকোচন ঘটে।
এই প্রসারণ ও সংকোচন একই পদার্থে সবদিকে সমানভাবে ঘটে। ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের
মধ্যে সমানভাবে ঘটে না, বিভিন্ন পদার্থের জন্য প্রসারণ ও সংকোচন বিভিন্ন
হয়।
কঠিন পদার্থের প্রসারণকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। তথা :-
দৈর্ঘ্য প্রসারণ
কোনো কঠিন পদার্থে তাপ প্রয়োগের ফলে শুধু দৈর্ঘ্যের দিকে প্রসারণ বিবেচনা করলে তাকে দৈর্ঘ্য প্রসারণ বলা হয়।
ক্ষেত্র প্রসারণ
কোনো কঠিন পদার্থে তাপ প্রয়োগের ফলে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের দিকে প্রসারণ বিবেচনা করলে তাকে ক্ষেত্র প্রসারণ বলা হয়।
আয়তন প্রসারণ
কোনো কঠিন পদার্থে তাপ প্রয়োগের ফলে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার দিকে প্রসারণ বিবেচনা করলে তাকে আয়তন প্রসারণ বলা হয়।
আজকের টপিক হচ্ছে দৈর্ঘ্য প্রসারণ তাই শুধু দৈর্ঘ্য প্রসারণ ও দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ সম্পর্কে এবং সৃজনশীল প্রশ্ন ও এর সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।
দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ
![]() |
চিত্রঃ দৈর্ঘ্য প্রসারণ। |
তাপ প্রয়োগে একই কঠিন পদার্থের প্রসারণ এর আদি দৈর্ঘ্য ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সমানুপাতিক।
ধরি, \(\theta_{1}\) প্রাথমিক তাপমাত্রায় একটি ধাতব পাতের আদি দৈর্ঘ্য
\(L_{0}\) এবং \(\theta_{2}\) তাপমাত্রায় ঐ ধাতব পাতের দৈর্ঘ্য \(L\),।
সুতরাং আমরা লিখতে পারি,
দৈর্ঘ্য প্রসারণ বা দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি = \(\Delta L\) = \(L-L_{0}\)
তাপমাত্রা বৃদ্ধি = \(\Delta \theta = \theta_{2}-\theta_{1}\)
অতএব,
\(\Delta L \propto L_{0}\Delta \theta\)
বা, \(\Delta L = \alpha L_{0}\Delta \theta\)
বা, \(\alpha = \frac{\Delta L}{L_{0}\Delta \theta}\)
এখানে \(\alpha\) হচ্ছে একটি সমানুপাতিক ধ্রুবক, এর মান পদার্থের উপাদান ও
তাপমাত্রা বৃদ্ধির উপর নির্ভরশীল। একে দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ বলে।
যদি আদি দৈর্ঘ্য (\(L_{0} = 1m\)) এক একক ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি (\(\Delta \theta =
1K\)) এক একক হয় তাহলে ,
\(\alpha = \Delta L\) হয়।
সুতরাং একক দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট কোনো কঠিন পদার্থের তাপমাত্রা এক কেলভিন বৃদ্ধি করলে এর ততটুকু দৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি ঘটে তাকে দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ বলে। দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগের একক হচ্ছে \(K^{-1}\)।
সৃজনশীল প্রশ্ন:
দুটি বৈদ্যুতিক খুঁটির মধ্যবর্তী দূরত্ব \(30\) মিটার। যেদিন \(30.001m\) দৈর্ঘ্যের একটি তামার তার দুটি খুঁটির সাথে সংযুক্ত ছিল সেদিন বাতাসের তাপমাত্রা ছিল \(30^{0}C\)। তামার দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ \(16.7 \times10^{-6}\) \( K^{-1}\)। একটি শীতের দিনে যখন বাতাসের তাপমাত্রা ছিল \(4^{0}C \)তখন তারটি ছিঁড়ে যায়।
(ক) পানির ত্রৈধ বিন্দুর সংজ্ঞা দাও।
(খ) দুটি বস্তুর তাপ একই হলেও এদের তাপমাত্রা ভিন্ন হতে পারে কি ? ব্যাখ্যা করো।
(গ) ফারেনহাইট স্কেলে বায়ুর তাপমাত্রা নির্ণয় করো।
(ঘ) গাণিতিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করো কেন তারটি ছিঁড়ে গেল ?
সমাধান
(ক) পানির ত্রৈধ বিন্দু হল তাপমাত্রা এবং চাপের অনন্য সমন্বয় যেখানে পানির তিনটি স্তর (কঠিন, তরল এবং গ্যাস) ভারসাম্যে সহাবস্থান করে। এই মুহুর্তে, পানি একই সাথে বরফ, তরল এবং জলীয় বাষ্প হিসাবে বিদ্যমান থাকতে পারে।
(খ) না, দুটি বস্তুর তাপের পরিমাণ সমান হলেও কিন্তু তাপমাত্রা একই হতে পারে না। তাপমাত্রা হল বস্তুর কণার গড় গতিশক্তির পরিমাপ। যদি দুটি বস্তুর তাপমাত্রা একই থাকে, তাহলে এর অর্থ হল তাদের কণার একই গড় গতিশক্তি রয়েছে। ব্যাখ্যা: 100 ক্যালরি তাপ 50 cc ও 100 cc পানিতে প্রদান করা হয় তাহলে 50 cc পানির অণুর গতিশক্তি 100 cc পানির অণুর গতিশক্তির চেয়ে বেশি হবে। তাই তাপমাত্রা ভিন্ন হবে।
(গ) ফারেনহাইট স্কেলে বায়ুর তাপমাত্রা প্রকাশ করতে, আমরা সূত্রটি ব্যবহার
করতে পারি:
\(F = (C \times \frac{ 9}{5}) + 32\)
এই ক্ষেত্রে, বায়ু তাপমাত্রা \(30 ^{0}C\).
সূত্রে এই মানটি
বসালে:
\(F = (30 \times \frac{9}{5}) + 32\)
বা, \(F = 54 + 32\)
\(\therefore\) \(F = 86\)
অতএব, ফারেনহাইট স্কেলে বায়ুর তাপমাত্রা \(86^{0}F\)।
(ঘ) তাপীয় প্রসারণের কারণে তারটি ছিঁড়ে যায়। যখন বাতাসের তাপমাত্রা
\(4^{0}C\) থেকে \(30^{0}C\) পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়, তখন তামার তারটিও দৈর্ঘ্যে
প্রসারিত হয়। তারের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন সূত্র ব্যবহার করে গণনা করা যেতে
পারে:
\(\Delta L = \alpha L \Delta \theta\)
যেখানে \(\Delta L\) হল দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন,
\(\alpha\) হল তামার অনুদৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ,
\(L\) হল তারের আদি দৈর্ঘ্য
এবং \(\Delta \theta \) হল তাপমাত্রার পরিবর্তন।
এই ক্ষেত্রে, তারের আদি দৈর্ঘ্য হল \(30.001m\), তামার দৈর্ঘ্য প্রসারণ সহগ
হল \(16.7 \times 10^{-6}\) \( K^{-1}\), এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন হল
\((30^{0}C - 4^{0}C) = 26^{0}C\)৷
সূত্রে এই মানগুলি বসিয়ে:
\(\Delta L \) = \(16.7 \times 10^{-6}\) \( K^{-1}\) \(\times\) \(30.001m
\) \(\times\) \(26^{0}C)\)
\(\Delta L = 0.013 m\)
অতএব, তারটি \(0.013 m\) প্রসারিত হয়। যেহেতু তারটি মূলত
\(30.001m\) লম্বা ছিল, তাই তারের মোট দৈর্ঘ্য \(30.001m + 0.013m =
30.014m\) হয়ে যায়। যেহেতু খুঁটির মধ্যবর্তী দূরত্ব মাত্র \(30.001 m\)
সেহেতু \(30.014 m\) দ্বারা তারের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য অতিক্রম করে।তাই তারটি
ছিঁড়ে যায়।