অর্ধপরিবাহী: শ্রেণি বিভাগ, পি টাইপ ও এন টাইপ বৈশিষ্ট্য এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ

সেমিকন্ডাক্টরের প্রকারভেদ (Classification of Semiconductor)

ভূমিকা

অর্ধপরিবাহী (সেমিকন্ডাক্টর) পদার্থ আমাদের আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি এমন একটি পদার্থ যা বিদ্যুৎ পরিবাহিতার দিক থেকে পরিবাহী এবং অপরিবাহীর মধ্যে অবস্থান করে। অর্ধপরিবাহী পদার্থের বৈশিষ্ট্যগুলি যেমন পি টাইপ এবং এন টাইপের মতো শ্রেণিবিন্যাস, ডোপিং, তাপমাত্রা, এবং বিদ্যুৎ প্রবাহে সংবেদনশীলতা ইত্যাদি, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের একটি প্রধান স্তম্ভ। এই প্রবন্ধে অর্ধপরিবাহীর শ্রেণি বিভাগ এবং তাদের প্রকারভেদ যেমন পি টাইপ ও এন টাইপ অর্ধপরিবাহী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি, এর বৈশিষ্ট্য এবং ব্যবহারিক প্রয়োগগুলি তুলে ধরা হবে।

অর্ধপরিবাহী (Semiconductor)

অর্ধপরিবাহী বলতে এমন একটি পদার্থকে বোঝায়, যার বিদ্যুৎ পরিবাহিতা ধাতুর তুলনায় কম এবং অপরিবাহী পদার্থের তুলনায় বেশি। এটি এমন ধরনের পদার্থ যা তাপমাত্রা এবং অন্যান্য অবস্থার উপর নির্ভর করে বিদ্যুৎ পরিবহন ক্ষমতা পরিবর্তন করতে পারে। ফলে অর্ধপরিবাহী পদার্থের বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা নিয়ন্ত্রণযোগ্য, যা ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অর্ধপরিবাহী পদার্থের উদাহরণ হিসেবে সিলিকন (Si) এবং জার্মেনিয়াম (Ge) এর কথা বলা যায়। এগুলো মূলত অর্ধপরিবাহী উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেমিকন্ডাক্টর পদার্থে বিদ্যুৎ পরিবহন ঘটে মূলত ইলেকট্রন এবং হোল নামক চার্জ বাহকের মাধ্যমে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা ডোপিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেমিকন্ডাক্টরের পরিবাহিতা বাড়ানো বা কমানো সম্ভব।

অর্ধপরিবাহী পদার্থ আজকের আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: ডায়োড, ট্রানজিস্টর, সৌর কোষ ইত্যাদি বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরিতে সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার করা হয়।

ইলেকট্রন ও হোলের ধারণা (Concept of Electron and Hole)

ইলেকট্রন হলো একটি মৌলিক কণা, যা ঋণাত্মক চার্জ বহন করে। এর আধানের পরিমাণ \(1.6 × 10^{-19} \, C\) এবং ভর \(9.1 × 10^{-31}\, kg\) । ইলেকট্রন পরমাণুর কেন্দ্রীয় অংশ থেকে দূরে অবস্থিত কক্ষপথে আবর্তিত হয়। উপযুক্ত শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ইলেকট্রনকে এই কক্ষপথ থেকে সরানো সম্ভব।

হোল হলো কোনো কঠিন পদার্থের ল্যাটিস কাঠামোতে ইলেকট্রন খালি করলে যে স্থান অবশিষ্ট থাকে, যা কার্যত ধনাত্মক চার্জ বাহক হিসেবে কাজ করে। কোনো সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের ইলেকট্রন মুক্ত হলে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়, তাকে হোল (Hole) বলে। অন্য একটি ইলেকট্রন যদি এই শূন্যস্থানে এসে অবস্থান নেয়, তবে প্রথম কক্ষটি পুনরায় ইলেকট্রনশূন্য হয়ে পড়ে, যা বিদ্যুৎ পরিবহনে সহায়তা করে। হোল এভাবে ধনাত্মক আধানের মতো আচরণ করে এবং পদার্থের ভেতর দিয়ে গমন করে।

সেমিকন্ডাক্টরের প্রকারভেদ (Classification of Semiconductor)

সেমিকন্ডাক্টর সাধারণত দুই ধরনের হয়ঃ

  1. ইনট্রিন্সিক বা অন্তর্জাত সেমিকন্ডাক্টর (Intrinsic semiconductor): যেসব সেমিকন্ডাক্টরে কোনো অপদ্রব্য মেশানো হয় না তাদের ইনট্রিন্সিক বা অন্তর্জাত সেমিকন্ডাক্টর বলে। পর্যায় সারণির চতুর্থ সারির মৌল যেমন কার্বন (C), সিলিকন (Si), জার্মেনিয়াম (Ge), টিন (Sn) প্রভৃতি পদার্থে মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম থাকে, যার ফলে এগুলোর পরিবাহিতাঙ্কও খুব বেশি নয়।
  2. এক্সট্রিন্সিক বা বহির্জাত সেমিকন্ডাক্টর (Extrinsic semiconductor): অন্তর্জাত সেমিকন্ডাক্টরে সামান্য পরিমাণে অপদ্রব্য (প্রায় এক কোটি পরমাণুতে একটি পরমাণু) মেশানোর মাধ্যমে এতে বিপুল পরিমাণে মুক্ত ইলেকট্রন বা হোল তৈরি হয়। এতে সেমিকন্ডাক্টরের পরিবাহিতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ডোপিং (doping) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ ধরনের সেমিকন্ডাক্টর তৈরি হয়। ডোপিংয়ের জন্য দুটি ধরণের উপাদান ব্যবহৃত হয়:
    • পর্যায় সারণির তৃতীয় সারির মৌল যেমন: বোরন (B), অ্যালুমিনিয়াম (Al), গ্যালিয়াম (Ga), ইন্ডিয়াম (In)।
    • পর্যায় সারণির পঞ্চম সারির মৌল যেমন: ফসফরাস (P), আর্সেনিক (As), এন্টিমনি (Sb), বিসমাথ (Bi)।

এক্সট্রিন্সিক সেমিকন্ডাক্টর দুটি ধরনের হতে পারে: p-টাইপ এবং n-টাইপ। ডোপিত উপাদানের প্রকৃতি থেকে নির্ধারণ করা হয় সেমিকন্ডাক্টরটি p-টাইপ (ধনাত্মক) হবে, না n-টাইপ (ঋণাত্মক) হবে।

জানেন কি? সেমিকন্ডাক্টর ডায়োড ছাড়া আজকের কম্পিউটার বা স্মার্টফোন চালানো প্রায় অসম্ভব! এটি একমুখী বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান উপাদান, যা ডিজিটাল যন্ত্রগুলোকে চালাতে সাহায্য করে।

p-টাইপ ও n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী

p-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর (p-type semiconductor)

কোনো বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরে সামান্য পরিমাণ ত্রিযোজী অর্থাৎ পর্যায় সারণির তৃতীয় সারির মৌল অপদ্রব্য হিসেবে মেশানো হলে, তাকে p-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর বলে।

p-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর

জার্মেনিয়াম এবং সিলিকনের পরমাণুতে সঠিক পরিমাণে (প্রায় এক কোটিতে একটি) ত্রিযোজী মৌল, যেমন গ্যালিয়াম বা অ্যালুমিনিয়াম, মেশালে কেলাসের গঠনে কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তবে, চতুর্যোজী ধাতুর সাথে সহযোজী বন্ধন গঠনের জন্য এক ইলেকট্রনের ঘাটতি পড়ে, ফলে কেলাসে একটি ধনাত্মক হোল সৃষ্টি হয়।

এই ধনাত্মক হোল পূরণের জন্য অন্য একটি ইলেকট্রনের প্রয়োজন হয়। ত্রিযোজী অপদ্রব্য ইলেকট্রন গ্রহণ করে বলে এদেরকে "গ্রাহক পরমাণু" বলা হয়। জার্মেনিয়াম বা সিলিকনের প্রতিটি গ্যালিয়াম বা অ্যালুমিনিয়াম পরমাণু একটি হোল সৃষ্টি করে, যা লক্ষ লক্ষ ধনাত্মক হোলের সৃষ্টি করে। গ্রাহক পরমাণুর বহির্খোলকে সাতটি যোজন ইলেকট্রন ও একটি হোল থাকে। যখন হোলটি ইলেকট্রন দ্বারা পূর্ণ হয়, পরমাণুর খোলকের গঠন স্থিতিশীল হয়।

ধনাত্মক হোল ইলেকট্রন গ্রহণ করে, ফলে ইলেকট্রনটি জার্মেনিয়াম বা সিলিকনের মধ্যে চলাচল করতে থাকে। এভাবে ইলেকট্রন পরমাণু থেকে পরমাণুতে গমন করে, যেন মনে হয় ধনাত্মক হোল পদার্থের মধ্যে ইলেকট্রনের বিপরীত দিকে চলমান। এই ধরনের পদার্থকে p-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর বলা হয়, যেখানে পরিবহন প্রধানত ধনাত্মক আধান (হোল) দ্বারা হয় এবং ইলেকট্রন হল লঘিষ্ঠ আধান বাহক।

n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর

n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর তখন তৈরি হয় যখন বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টরে সামান্য পরিমাণ পঞ্চযোজী মৌল মেশানো হয়। এই পঞ্চযোজী মৌলগুলো পর্যায় সারণির পঞ্চম সারির মৌল হিসেবে পরিচিত।

যদি এক কোটি পরমাণুতে একটি পঞ্চযোজী মৌল মেশানো হয়, তাহলে কেলাসের গঠনে কোনো পরিবর্তন হবে না। মিশ্রিত পরমাণুর পাঁচটি যোজন ইলেকট্রনের মধ্যে চারটি জার্মেনিয়াম বা সিলিকনের পরমাণুর সাথে সহযোজী বন্ধন গঠন করবে, আর একটি ইলেকট্রন উদ্বৃত্ত থাকবে। এই উদ্বৃত্ত ইলেকট্রনকে খুব সামান্য শক্তি দিয়ে মুক্ত করা সম্ভব, যা n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরের বৈশিষ্ট্য।

এবং এরাই সেমিকন্ডাক্টরের পরিবাহিতা বৃদ্ধি করে। পঞ্চযোজী অপদ্রব্য ইলেকট্রন দান করে বলে এদের দাতা (donor) পরমাণু বলে। ইলেকট্রনের দ্বারা পরিবাহিতা বৃদ্ধি পায় বলে এই ধরনের এক্সট্রিন্সিক সেমিকন্ডাক্টরকে n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর বলে। জার্মেনিয়াম বা সিলিকনে প্রতিটি আর্সেনিক বা এন্টিমনি পরমাণু একটি করে ইলেকট্রন দান করে। ফলে সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক বা এন্টিমনি লক্ষ লক্ষ ইলেকট্রন দান করে। n-টাইপ বস্তুকে ইলেকট্রন সমৃদ্ধ বস্তু বলা হয়। n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে পরিবহন ঘটে প্রধানত ঋণাত্মক আধান বা ইলেকট্রনের জন্য। এতে গরিষ্ঠ বাহক (majority carrier) হলো ইলেকট্রন এবং লঘিষ্ঠ বাহক (minority carrier) হলো হোল।

p-টাইপ ও n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে আধান

Charge on p-type and n-type semiconductors

পূর্বের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, p-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে তড়িৎপ্রবাহ হয় হোল-এর জন্য এবং n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে তড়িৎপ্রবাহ হয় অতিরিক্ত ইলেকট্রনের জন্য। এতে সাধারণভাবে ধারণা হতে পারে p-টাইপ বস্তুতে অতিরিক্ত ধনাত্মক আধান এবং n-টাইপ বস্তুতে অতিরিক্ত ঋণাত্মক আধান রয়েছে বা মনে হতে পারে p-টাইপ বস্তু হচ্ছে ধনাত্মক আধান আহিত বস্তু আর n-টাইপ বস্তু হচ্ছে ঋণাত্মক আধান আহিত বস্তু

প্রকৃত অবস্থা কিন্তু তা নয়। একথা সত্য যে n-টাইপ বস্তুতে অতিরিক্ত কিছু ইলেকট্রন আছে। কিন্তু এই অতিরিক্ত ইলেকট্রন সরবরাহ করে দাতা অপদ্রব্য, যা নিজে তড়িৎ নিরপেক্ষ। যখন অপদ্রব্য মেশানো হয়, তখন যাকে 'অতিরিক্ত ইলেকট্রন' বলা হয়, তা মূলত সেমিকন্ডাক্টর কেলাসে সহযোজী বন্ধন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইলেকট্রনের অতিরিক্ত। এই অতিরিক্ত ইলেকট্রন মুক্ত ইলেকট্রন এবং এরা সেমিকন্ডাক্টরের পরিবাহিতা বৃদ্ধি করে। p-টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে একইভাবে অতিরিক্ত হোল পাওয়া যায়। তাই বলা যায়, p-টাইপ ও n-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর প্রকৃতপক্ষে তড়িৎ নিরপেক্ষ

অর্ধপরিবাহীর বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহারিক প্রয়োগ

অর্ধপরিবাহীর বৈশিষ্ট্য

অর্ধপরিবাহী উপাদানগুলি হল এমন পদার্থ যা পরিবাহী এবং অপরিবাহী উপাদানগুলির মধ্যে বিদ্যমান। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • তাপমাত্রার সঙ্গে পরিবর্তনশীল পরিবাহিতা
  • পৃথক প্রকারের ইলেকট্রন ও হোল পরিচালনা
  • ডোপিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ
  • বিদ্যুৎ শক্তির সংবেদনশীলতা

ব্যবহারিক প্রয়োগ

অর্ধপরিবাহী উপাদানগুলি প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক প্রয়োগ হলো:

  • ডায়োড: একমুখী বিদ্যুৎ প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
  • ট্রানজিস্টর: সংকেত বৃদ্ধি এবং সুইচিং অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে ব্যবহৃত হয়।
  • সোলার সেল: সৌর শক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করতে ব্যবহৃত হয়।
  • এলইডি (LED): আলো উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, যা শক্তি সাশ্রয়ী।

উপসংহার

অর্ধপরিবাহী পদার্থ এবং এর বিভিন্ন প্রকারভেদ, যেমন পি টাইপ ও এন টাইপ, আমাদের আধুনিক জীবনকে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যন্ত, অর্ধপরিবাহীর ব্যবহারিক প্রয়োগ আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। এটির বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণি বিভাগ যেমন এটি একটি গতিশীল এবং ক্রমবর্ধমান গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে, তেমনি আমাদের আগামী দিনের প্রযুক্তির অগ্রগতিতে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন