বীট বা স্বরকম্প: শব্দ তরঙ্গের গাণিতিক বিশ্লেষণ ও শ্রবণযোগ্য ধ্বনিকম্পের ব্যাখ্যা
ভূমিকা
শব্দ তরঙ্গের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে বীট বা স্বরকম্প একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ঘটনা। যখন দুটি প্রায় সমান কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট শব্দ তরঙ্গ একত্রে সৃষ্টি হয়, তখন শ্রোতা একটি নির্দিষ্ট হারে শব্দের তীব্রতা হ্রাস-বৃদ্ধি অনুভব করেন। এই তীব্রতার পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনকে বীট বা স্বরকম্প বলা হয়। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেমন সুরকার্য বা বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি শব্দ তরঙ্গের গাণিতিক বিশ্লেষণেও এক অসাধারণ বৈজ্ঞানিক উদাহরণ।
এই আলোচনায় শব্দ তরঙ্গের গাণিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বীট কীভাবে সৃষ্টি হয় তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শব্দ তরঙ্গের সমীকরণ, তাদের কম্পাঙ্কের পার্থক্য, এবং তরঙ্গদ্বয়ের মিলিত প্রভাব থেকে বীটের উৎপত্তি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে।
স্বরকম্প বা বীট
স্বরকম্প বা বীট হলো এমন একটি ঘটনা যেখানে সমান বা প্রায় সমান তীব্রতা এবং প্রায় সমান কম্পাঙ্কের দুটি শব্দ তরঙ্গ একসঙ্গে উৎপন্ন হলে শব্দের তীব্রতা একবার বাড়ে এবং একবার কমে।
সংজ্ঞা:
সমান বা প্রায় সমান তীব্রতা এবং প্রায় সমান কম্পাঙ্কবিশিষ্ট দুটি শব্দ তরঙ্গের উপরিপাতনের ফলে শব্দের তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধির ঘটনাকে স্বরকম্প বা বীট বলে।
ব্যাখ্যা:
সমান কম্পাঙ্কের দুটি সুর শালাকা নিয়ে তাদেরকে একটি ফাঁপা বাক্সের উপর স্থাপন করলে তারা একটানা শব্দ উৎপন্ন করে। একটি সুর শালাকার এক বাহুতে কিছু মোম লাগিয়ে ভারী করলে তার কম্পাঙ্ক কমে যায় এবং সুর শলাকা দুটির কম্পাঙ্কের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় সুর শলাকা দুটিকে একসঙ্গে আঘাত করলে শব্দের তীব্রতা পর্যায়ক্রমে জোরে এবং ধীরে শোনা যায়।
উদাহরণ:
দুটি শব্দ উৎসের ক্রিয়ায় প্রতি সেকেন্ডে ৫টি বীট উৎপন্ন হলে বুঝায় যে শব্দের তীব্রতা প্রতি সেকেন্ডে ৫ বার হ্রাস-বৃদ্ধি হয় এবং উৎসদ্বয়ের কম্পাঙ্কের পার্থক্য ৫ Hz।
বীট বা স্বরকম্প গঠনের কৌশল
১. দুটি শব্দ তরঙ্গের মিলন: প্রায় সমান কম্পাঙ্কবিশিষ্ট দুটি শব্দ তরঙ্গ যখন একই মাধ্যমের একটি বিন্দুতে মিলিত হয়, তখন তাদের দশা (ফেজ) সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। এক সময়ে তারা একই দশায় থাকে, ফলে শব্দের তীব্রতা বেশি হয়। আবার অন্য সময়ে তারা বিপরীত দশায় থাকে, ফলে শব্দের তীব্রতা কমে যায়।
২. দশার পরিবর্তন: তরঙ্গদ্বয়ের দশা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। যখন তারা একই দশায় থাকে, তখন তাদের তরঙ্গের যোগফল বেশি হয় এবং শব্দের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। বিপরীত দশায় থাকলে, তরঙ্গদ্বয়ের বিয়োগফল হয় এবং শব্দের তীব্রতা কমে যায়।
৩. তীব্রতার পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন: শব্দের তীব্রতার এই পর্যায়ক্রমিক হ্রাস-বৃদ্ধিকেই বীট বা স্বরকম্প বলা হয়। প্রতি সেকেন্ডে শব্দের তীব্রতার এই পরিবর্তনের সংখ্যা দ্বারা বীটের সংখ্যা নির্ণীত হয়।
উদাহরণ
ধরা যাক, দুটি সুর শলাকা আঘাত করে শব্দ তরঙ্গ উৎপন্ন করা হয়েছে। এই তরঙ্গ
দুটি যখন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে, তখন তারা এক বিন্দুতে মিলিত হয়।
A বিন্দুতে: তরঙ্গ দুটি একই দশায় মিলিত হয়, ফলে শব্দের
তীব্রতা বেশি হয়।
B বিন্দুতে: তরঙ্গ দুটি বিপরীত দশায় মিলিত হয়, ফলে শব্দের
তীব্রতা কমে যায়।
C বিন্দুতে: তরঙ্গ দুটি আবার একই দশায় মিলিত হয়, ফলে
শব্দের তীব্রতা আবার বেশি হয়।
গণিতের সাহায্যে ব্যাখ্যা
ধরা যাক, দুটি শব্দ তরঙ্গের কম্পাঙ্ক \(f_1\) এবং \(f_2\)। বীটের কম্পাঙ্ক হবে \(|f_1 - f_2|\)। অর্থাৎ, দুটি তরঙ্গের কম্পাঙ্কের পার্থক্যই বীটের কম্পাঙ্ক নির্ধারণ করে।
আশা করি, এই ব্যাখ্যাটি আপনার জন্য আরও স্পষ্ট হয়েছে। যদি আরও কিছু জানতে চান, নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করতে পারেন!
বীট বা ধ্বনিকম্পের গাণিতিক বিশ্লেষণ (Mathematical analysis of beat)
ধরা যাক দুটি শব্দগতীয় সূর শালাকার কম্পাঙ্কের \(n_1\) ও \(n_2\); (\(n_1 \gt n_2\)) এবং কম্পাঙ্ক দুইটির পার্থক্য খুব বেশী নয়। আবার ধরা যাক শালাকার দুটি সূর একই সময়ে কোন একটি স্থানে একই সমতলায় আপতিত হয়। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী দুইটি ধ্বনি তরঙ্গের সরণ হবে:
\[ y_1 = a \sin 2 \pi n_1 t \] \[ y_2 = b \sin 2 \pi n_2 t \] দুটি ধ্বনির যোগফল:
\[ y = y_1 + y_2 \] \[ = a \sin 2 \pi n_1 t + b \sin 2 \pi n_2 t \] যদি \(a = b\) হয়, তবে:
\[ y = a (\sin 2 \pi n_1 t + \sin 2 \pi n_2 t) \] \[= 2a \sin \pi \left( \frac{n_1 + n_2}{2} \right) t\] \[\times \cos 2 \pi \left( \frac{n_1 - n_2}{2} \right) t \]
অথবা,
\[ y = \left[ 2a \cos 2 \pi \left( \frac{n_1 - n_2}{2} \right) t \right]\] \[\times \sin 2 \pi \left( \frac{n_1 + n_2}{2} \right) t \]
এখানে $$ A = 2a \cos 2 \pi \left( \frac{n_1 - n_2}{2} \right) t$$ এবং $$ M = \frac{n_1 + n_2}{2}$$ তাহলে
\[ y = A \sin 2 \pi M t \]
এই সমীকরণে \(A\) এর মানের পরিবর্তন ঘটলে শব্দের তীব্রতা হ্রাস-বৃদ্ধি পায়।
বীট উৎপত্তির শর্ত
- ১। বীট সৃষ্টিকারী শব্দ তরঙ্গ দুটি একই সময়ে উৎপন্ন হতে হবে।
- ২। তরঙ্গ দুটির কম্পাঙ্ক ও তীব্রতা প্রায় সমান হতে হবে।
- ৩। তরঙ্গ দুটির দরুন মাধ্যমের কোন একটি কণার সরণ একই রেখায় হতে হবে।
উপসংহার
বীট বা স্বরকম্প শব্দ তরঙ্গের একটি চমৎকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, যা শব্দ তরঙ্গের গাণিতিক বিশ্লেষণ ও শ্রোতার অনুভূতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দুটি প্রায় সমান কম্পাঙ্কের তরঙ্গের একত্র প্রক্ষেপণে যে পর্যায়ক্রমিক তীব্রতার পরিবর্তন ঘটে, তা শুধু গণিতীয়ভাবে নয়, শ্রবণগত দিক থেকে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই ব্যাখ্যা শব্দ প্রকৃতির সৌন্দর্য ও বৈজ্ঞানিক গঠনপ্রণালী সম্পর্কে গভীর ধারণা দেয়।
গাণিতিক সমস্যা ও সমাধান
দুটি সুর কম্পাঙ্ক \(A\) ও \(B\) একই সময়ে শ্রবণ করলে প্রতি সেকেন্ডে \(6\)টি বিট উৎপন্ন হয়। কিন্তু \(A\)-তে ধ্বনিকোটা ক্রমে কমে যাওয়ার বিটের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। \(B\)-এর কম্পাঙ্ক \(320\) \(Hz\) হলে, \(A\)-এর কম্পাঙ্ক নির্ণয় কর।
উত্তর:
আমরা পাই, \(N = n_1 - n_2\)
প্রশ্নমতে ভর বৃদ্ধিতে \(A\)-এর কম্পাঙ্ক ক্রমে বৃদ্ধি পায়।
কাজেই \(A\)-এর কম্পাঙ্ক,
\(n_1 \gt B\)-এর কম্পাঙ্ক, \(n_2\)
কাজেই, \(N = n_1 - n_2\)
এখানে, \(N = 6\) বিট/সে. ও \(n_2 = 320\) Hz
\( n_1 = n_2 + N = (320 + 6) \, \text{Hz} \)
অতএব, \( n_1 = 326 \) Hz