এক্স-রে, তেজস্ক্রিয়তা, ডোপিং, ইলেকট্রন রশ্মি, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও কম্পিউটার: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বিত আলোচনা

এক্স-রে, তেজস্ক্রিয়তা, ডোপিং, ইলেকট্রন রশ্মি, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও কম্পিউটার প্রযুক্তির কার্যপ্রণালী, ব্যবহার ও প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বিত ও সহজবোধ্য আলোচনা।


পদার্থবিজ্ঞানের ৬টি বিস্ময়কর ধারণা যা আপনার পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেবে

প্রতিদিন আমরা অসংখ্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করি—এক্স-রে, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার। এই প্রযুক্তিগুলো আমাদের জীবনকে এতটাই সহজ করে দিয়েছে যে আমরা এগুলোকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিই। কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, এই বিস্ময়কর যন্ত্রগুলোর পেছনে কোন বৈজ্ঞানিক নীতি কাজ করে? কোন আবিষ্কারগুলো আমাদের পৃথিবীকে এভাবে বদলে দিয়েছে?

এই প্রবন্ধে আমরা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এবং ইলেকট্রনিক্সের এমন কিছু যুগান্তকারী ও আশ্চর্যজনক ধারণা নিয়ে আলোচনা করব, যা আমাদের বাস্তবতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। এই আবিষ্কারগুলোর কয়েকটির জন্ম হয়েছিল প্রায় জাদুকরী এক আকস্মিকতায়, আবার অন্যগুলো গড়ে উঠেছে এমন জটিল প্রকৌশলের উপর যা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। চলুন, বিজ্ঞানের সেই বিস্ময়কর জগতে প্রবেশ করা যাক যা আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে চালনা করছে।


১. এক্স-রে আবিষ্কার হয়েছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে

১৮৯৫ সাল। জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেলম রন্টজেন একটি ক্ষরণ নলে (discharge tube) ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। পরীক্ষা করার সময় তিনি নলটিকে পুরোপুরি ঢেকে রেখেছিলেন, কিন্তু হঠাৎ তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন যে কাছেই রাখা একটি বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড পর্দা থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে।

চিত্রঃ এক্সরে

তিনি বুঝতে পারছিলেন, নলটি ঢাকা থাকা সত্ত্বেও কোনো এক অজানা, অদৃশ্য রশ্মি সেখান থেকে নির্গত হয়ে পর্দায় এই আলোর আভা তৈরি করছে। যেহেতু এই রশ্মির প্রকৃতি তার জানা ছিল না, তাই তিনি এর নাম দেন "এক্স-রে" বা "অজানা রশ্মি"। কে জানত, পরীক্ষাগারের এই একটি আকস্মিক ঘটনাই চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করবে এবং কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচানোর মাধ্যম হয়ে উঠবে। রন্টজেনের এই আবিষ্কারটিই যেন খুলে দিয়েছিল পরমাণুর এক নতুন রহস্যের দুয়ার, যা ঠিক পরের বছরই আরও এক বিস্ময়ের জন্ম দেয়।


২. কিছু পদার্থ আপনাআপনিই অদৃশ্য রশ্মি নির্গত করে

এক্স-রে আবিষ্কারের ঠিক পরের বছর, ১৮৯৬ সালে, ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল আরও একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। তিনিও অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই আবিষ্কার করেন যে ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম বা রেডিয়ামের মতো কিছু ভারী মৌল কোনো বাইরের প্রভাব ছাড়াই নিজে থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলফা, বিটা এবং গামার মতো শক্তিশালী রশ্মি নির্গত করতে থাকে।

চিত্রঃ তেজস্ক্রিয় পদার্থ

এই অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে মেরি কুরি এবং পিয়ের কুরি ব্যাপক গবেষণা করেন এবং এই প্রক্রিয়ার নাম দেন তেজস্ক্রিয়তা। এই ধারণাটি তৎকালীন বিজ্ঞানীদের জন্য অত্যন্ত বিস্ময়কর ছিল, কারণ এটি প্রমাণ করে যে পরমাণু অবিভাজ্য নয় এবং এর নিউক্লিয়াসের ভেতরেও বিপুল পরিমাণ শক্তি লুকিয়ে আছে।

"পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রশ্মি বিকিরণের প্রক্রিয়াকেই তেজস্ক্রিয়তা বলে।"

পরমাণুর নিউক্লিয়াসের এই লুকানো শক্তি যেমন বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছিল, তেমনি এর ইলেকট্রন বিন্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা জন্ম দিয়েছিল আধুনিক প্রযুক্তির।


৩. সামান্য অপদ্রব্যের ছোঁয়ায় পরিবাহিতা বাড়ে ১০০০ গুণ!

আমরা জানি, কিছু পদার্থ বিদ্যুৎ পরিবহন করে (পরিবাহী), কিছু করে না (অপরিবাহী), আর কিছুর অবস্থান এদের মাঝামাঝি (অর্ধপরিবাহী)। সিলিকন বা জার্মেনিয়ামের মতো বিশুদ্ধ অর্ধপরিবাহীর বিদ্যুৎ পরিবাহিতা খুব কম থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন এক জাদুকরী কৌশল, যার নাম "ডোপিং"।

চিত্রঃ পি টাইপ ও এন টাইপ সেমিকন্ডাক্টর

ডোপিং হলো বিশুদ্ধ অর্ধপরিবাহীর সাথে অতি সামান্য পরিমাণে (যেমন, ১০ লক্ষ পরমাণুতে একটি) নির্দিষ্ট কোনো অপদ্রব্য মেশানোর প্রক্রিয়া। আশ্চর্যজনকভাবে, এই সামান্য অপদ্রব্য মেশানোর ফলে অর্ধপরিবাহীর বিদ্যুৎ পরিবাহিতা প্রায় ১০০০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়! যখন আর্সেনিকের মতো পঞ্চযোজী অপদ্রব্য মেশানো হয়, তখন তাতে মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং এটি n-টাইপ অর্ধপরিবাহীতে পরিণত হয়। আবার, অ্যালুমিনিয়ামের মতো ত্রিযোজী অপদ্রব্য মেশালে তাতে "হোল" (ইলেকট্রনের ঘাটতি) তৈরি হয় এবং এটি p-টাইপ অর্ধপরিবাহীতে পরিণত হয়। আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের ভিত্তি, অর্থাৎ ডায়োড এবং ট্রানজিস্টর, এই ডোপিং প্রক্রিয়ার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। ডোপিং-এর মাধ্যমে ইলেকট্রনকে নিয়ন্ত্রণ করার এই নীতিই খুলে দিয়েছিল টেলিভিশনের মতো প্রযুক্তির দরজা, যেখানে একটি ইলেকট্রন রশ্মিই তৈরি করে চলমান ছবির জাদু।


৪. টেলিভিশনের ছবি আসলে ইলেকট্রনের কারসাজি

টেলিভিশনের পর্দায় আমরা যে চলমান ছবি দেখি, তা আসলে একটি স্থির চিত্র নয়; এটি আমাদের চোখের ভ্রম। এই ভ্রম তৈরি হয় একটি অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন ইলেকট্রন রশ্মির মাধ্যমে। এই রশ্মিটি টেলিভিশনের ফসফর লাগানো পর্দায় সেকেন্ডে ২৫ বার পুরো ছবিটিকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত "স্ক্যান" করে বা এঁকে দিয়ে যায়।

চিত্রঃ টিভি পর্দায় ইলেকট্রন বীম

প্রযুক্তিটি আরও জটিল। পুরো ছবিটিকে ৬২৫টি আনুভূমিক লাইনে ভাগ করা হয়। ইলেকট্রন রশ্মি প্রথমে ৩১২.৫টি বিজোড় লাইন (১, ৩, ৫...) এঁকে ফেলে, তারপর দ্রুত উপরে ফিরে গিয়ে বাকি ৩১২.৫টি জোড় লাইনের (২, ৪, ৬...) ফাঁকা জায়গাগুলো পূরণ করে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি এতটাই দ্রুত ঘটে যে আমাদের চোখ আলাদা লাইনগুলোকে ধরতে পারে না এবং আমরা একটি মসৃণ, চলমান ছবি দেখতে পাই। এই অবিশ্বাস্য গতি এবং নিখুঁত সমন্বয়ই টেলিভিশনের জাদুর পেছনের মূল কারণ। টেলিভিশন যেমন দূর থেকে ছবি আর শব্দ আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়, ঠিক তেমনি মোবাইল ফোনও অদৃশ্য তরঙ্গের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে যোগাযোগের এক জটিল জাল তৈরি করেছে, তবে এর পথচলা আরও অনেক বেশি ঘুরপথের।


৫. আপনার মোবাইল কল সরাসরি বন্ধুর কাছে যায় না

আমরা যখন মোবাইল থেকে কাউকে ফোন করি, তখন অনেকেই ভাবি যে সংকেতটি হয়তো সরাসরি আমাদের ফোন থেকে বন্ধুর ফোনে চলে যায়। কিন্তু বাস্তবতা এর থেকে অনেক বেশি জটিল। আপনার বলা "হ্যালো" শব্দটি বন্ধুর কানে পৌঁছানোর আগে এক বিশাল অবকাঠামো পাড়ি দেয়।

চিত্রঃ মোবাইলের কার্যপদ্ধতি

প্রথমে, আপনার ফোন থেকে সংকেতটি যায় আপনার সবচেয়ে কাছের মোবাইল টাওয়ারে, যাকে বলে BTS (Base Tower Station)। সেখান থেকে সংকেতটি পাঠানো হয় BSC (Base Station Centre)-এ। এরকম অনেকগুলো BSC যুক্ত থাকে একটি MSC (Mobile Switching Centre)-এর সাথে। আপনার এলাকার MSC তখন খুঁজে বের করে আপনার বন্ধুর ফোনটি কোন MSC-র অধীনে আছে এবং অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে সেই MSC-র সাথে সংযোগ স্থাপন করে। এরপর সংকেতটি উল্টো পথে অপর প্রান্তের MSC থেকে BSC, তারপর BTS হয়ে আপনার বন্ধুর ফোনে পৌঁছায়। এই পুরো জটিল পথ পাড়ি দেওয়ার কাজটি ঘটে যায় এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে! মোবাইল ফোনের এই জটিল নেটওয়ার্কের পেছনে থাকা মূল মস্তিষ্ক হলো কম্পিউটার, এমন এক যন্ত্র যা নিজে থেকে কিছু না পারলেও মানুষের নির্দেশ পালনে অকল্পনীয়ভাবে নিখুঁত।


৬. কম্পিউটার নিজে থেকে কিছুই পারে না, কিন্তু ভুলও করে না

কম্পিউটারকে আমরা একটি বুদ্ধিমান যন্ত্র হিসেবে জানলেও এর একটি মৌলিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কম্পিউটার মূলত একটি গণনাকারী যন্ত্র যা গাণিতিক এবং যৌক্তিক কাজ করতে পারে। কিন্তু এর নিজে থেকে কিছু করার কোনো ক্ষমতা নেই। ব্যবহারকারী তাকে যেভাবে নির্দেশনা দেয়, সে শুধু অক্ষরে অক্ষরে তাই পালন করে।

চিত্রঃ কম্পিউটার

তবে এর ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে কম্পিউটারের আসল শক্তি। এটি অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে, ক্লান্তিহীনভাবে এবং নির্ভুলভাবে কাজ করতে পারে। একটি কম্পিউটার নিজে থেকে কখনোই কোনো ভুল করে না। যদি ব্যবহারকারীর দেওয়া তথ্য বা নির্দেশনায় কোনো ভুল না থাকে, তবে কম্পিউটার সর্বদা সঠিক ফলাফলই প্রদান করবে। নির্ভুলভাবে নির্দেশ পালনের এই ক্ষমতাই কম্পিউটারকে মানব ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত করেছে।

"কম্পিউটার নিজে কোনো ভুল করে না। অর্থাৎ ব্যবহারকারীর প্রদত্ত নির্দেশনা বা উপাত্তে ভুল না থাকলে কম্পিউটার কখনোই ভুল ফলাফল প্রদান করে না।"

দুর্ঘটনাবশত খুঁজে পাওয়া একটি অদৃশ্য রশ্মি থেকে শুরু করে হাতের মুঠোয় থাকা কম্পিউটারের অবিশ্বাস্য নির্ভুলতা পর্যন্ত— প্রতিটি ধারণাই মানুষের অদম্য কৌতূহল এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। আমাদের আধুনিক বিশ্ব এমন সব বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে যা প্রায়শই আমাদের সাধারণ ধারণার বাইরে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতিটি আবিষ্কার মানবজীবনকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছে। এক্স-রে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব এনেছে, তেজস্ক্রিয়তা গবেষণা ও শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, ডোপিং সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিচ্ছে, ইলেকট্রন রশ্মি আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম টেলিভিশনের ভিত্তি স্থাপন করেছে। অন্যদিকে মোবাইল নেটওয়ার্ক আমাদের বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে এবং কম্পিউটার জ্ঞানের বিস্তার থেকে শুরু করে আধুনিক সভ্যতার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করছে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, এসব প্রযুক্তি শুধু আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করছে না, বরং ভবিষ্যতের উন্নত সমাজ গঠনের পথও প্রশস্ত করছে।

এইসব জানতে পেরে, আপনার চারপাশের কোন প্রযুক্তিটিকে এখন সবচেয়ে বিস্ময়কর বলে মনে হচ্ছে?

মন্তব্যসমূহ