অর্ধপরিবাহী: প্রকারভেদ, P-টাইপ ও N-টাইপ অর্ধপরিবাহী এবং ট্রানজিস্টরের বিস্তারিত আলোচনা - আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের ভিত্তি

অর্ধপরিবাহী (Semiconductor)

আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের ভিত্তি হলো অর্ধপরিবাহীবা সেমিকন্ডাক্টর। কম্পিউটার প্রসেসর থেকে শুরু করে আপনার হাতে থাকা স্মার্টফোন—সবকিছুর পেছনেই রয়েছে এই ক্ষুদ্র উপাদানের বিশাল অবদান। এই প্রবন্ধে আমরা অর্ধপরিবাহীর সংজ্ঞা, এর বিভিন্ন প্রকারভেদ, P-টাইপ ও N-টাইপ অর্ধপরিবাহীকী এবং ইলেকট্রনিক্সের জাদুকর ট্রানজিস্টরকীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

অর্ধপরিবাহী কী? (What is Semiconductor?)

বিদ্যুৎ পরিবাহিতার ভিত্তিতে পদার্থকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়: পরিবাহী (Conductor), অন্তরক (Insulator), এবং অর্ধপরিবাহী (Semiconductor)।

অর্ধপরিবাহী হলো সেই সব পদার্থ, যাদের রোধ বা পরিবাহিতা পরিবাহী (যেমন তামা) এবং অন্তরক (যেমন রাবার) পদার্থের মাঝামাঝি। সাধারণ বা কক্ষ তাপমাত্রায় (\(T \approx 300\text{K}\)) এরা অন্তরকের মতো আচরণ করে, কিন্তু তাপমাত্রা বাড়ালে বা উপযুক্ত অপদ্রব্য মেশালে এদের পরিবাহিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

বহুল ব্যবহৃত দুটি অর্ধপরিবাহী হলো সিলিকন (Si)এবং জার্মেনিয়াম (Ge)। পর্যায় সারণির এই মৌলগুলোর যোজনী স্তরে (Valence Shell) চারটি ইলেকট্রন থাকে।

ব্যান্ড তত্ত্বের আলোকে পরিবাহিতা

ব্যান্ড তত্ত্ব অনুসারে, পদার্থের পরিবাহিতা নির্ভর করে যোজন ব্যান্ড (Valence Band) এবং পরিবহন ব্যান্ড (Conduction Band) এর মধ্যবর্তী শক্তি-ব্যবধান (Energy Gap) এর উপর। এই ব্যবধানকে বলা হয় নিষিদ্ধ শক্তি-ব্যবধান (\(E_g\))।

  • পরিবাহী: এদের ক্ষেত্রে \(E_g \approx 0 \text{ eV}\)। যোজন ও পরিবহন ব্যান্ড একে অপরের উপর উপরিপাতিত থাকে।
  • অন্তরক: এদের ক্ষেত্রে \(E_g\) অনেক বেশি (সাধারণত \(E_g \gt 3 \text{ eV}\))। কক্ষ তাপমাত্রায় কোনো ইলেকট্রন পরিবহন ব্যান্ডে যেতে পারে না।
  • অর্ধপরিবাহী: এদের ক্ষেত্রে \(E_g\) খুবই কম। যেমন: সিলিকনের জন্য \(E_g \approx 1.12 \text{ eV}\) এবং জার্মেনিয়ামের জন্য \(E_g \approx 0.67 \text{ eV}\)। তাপমাত্রা বাড়লে ইলেকট্রন সহজেই যোজন ব্যান্ড থেকে পরিবহন ব্যান্ডে লাফিয়ে যেতে পারে।

অর্ধপরিবাহীর প্রকারভেদ

অর্ধপরিবাহী প্রধানত দুই প্রকার:

১. বিশুদ্ধ বা অন্তর্জাত অর্ধপরিবাহী (Intrinsic Semiconductor)

যে অর্ধপরিবাহীতে কোনো প্রকার অপদ্রব্য মেশানো থাকে না, তাকে বিশুদ্ধ অর্ধপরিবাহীবলে। যেমন, বিশুদ্ধ সিলিকন বা জার্মেনিয়াম।

বিশুদ্ধ অর্ধপরিবাহীতে তড়িৎ প্রবাহের জন্য ইলেকট্রন এবং হোল(Hole) উভয়ই সমান সংখ্যায় থাকে। তাপের কারণে যখন কোনো সমযোজী বন্ধন ভাঙে, তখন একটি মুক্ত ইলেকট্রন এবং একটি হোলের সৃষ্টি হয়।

মুক্ত ইলেকট্রন এর সংখ্যা \((n_e)\) = হোলের সংখ্যা \((n_h) = n_i\)

যেখানে \(n_i\) হলো অন্তর্জাত বাহক ঘনত্ব।

২. অবিশুদ্ধ বা বহির্জাত অর্ধপরিবাহী (Extrinsic Semiconductor)

বিশুদ্ধ অর্ধপরিবাহীর পরিবাহিতা বাড়ানোর জন্য যখন খুব সামান্য পরিমাণে উপযুক্ত অপদ্রব্য মেশানো হয়, তখন তাকে বহির্জাত অর্ধপরিবাহীবলে। এই অপদ্রব্য মেশানোর প্রক্রিয়াকে ডোপিং(Doping) বলা হয়। অপদ্রব্যের ধরনের উপর ভিত্তি করে বহির্জাত অর্ধপরিবাহী আবার দুই প্রকার:

P-টাইপ অর্ধপরিবাহী: গঠন ও কার্যপ্রণালী

P-টাইপ (Positive Type) অর্ধপরিবাহী তৈরি করতে বিশুদ্ধ অর্ধপরিবাহীর সাথে ত্রিযোজী (Trivalent) অপদ্রব্য মেশানো হয়।

ডোপিং প্রক্রিয়া

বিশুদ্ধ সিলিকন বা জার্মেনিয়ামের সাথে অ্যালুমিনিয়াম (Al), বোরন (B), বা গ্যালিয়াম (Ga)-এর মতো ত্রিযোজী মৌল অপদ্রব্য হিসেবে মেশানো হয়। এই অপদ্রব্যগুলিকে গ্রহীতা অপদ্রব্য(Acceptor Impurity) বলা হয়।

ত্রিযোজী মৌলের তিনটি যোজন ইলেকট্রন পার্শ্ববর্তী চারটি সিলিকন পরমাণুর তিনটির সাথে সমযোজী বন্ধন তৈরি করে। চতুর্থ বন্ধনটিতে একটি ইলেকট্রনের ঘাটতি থাকে, যা একটি হোলেরজন্ম দেয়।

ত্রিযোজী অপদ্রব্য + \(\text{Ge/Si}\) \(\rightarrow\) P-টাইপ অর্ধপরিবাহী + হোল

আধান বাহক (Charge Carriers)

P-টাইপ অর্ধপরিবাহীতে, হোলের সংখ্যা মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি থাকে।

  • সংখ্যাগুরু আধান বাহক (Majority Carrier): হোল(ধনাত্মক চার্জবাহী)।
  • সংখ্যালঘু আধান বাহক (Minority Carrier): মুক্ত ইলেকট্রন(ঋণাত্মক চার্জবাহী)।

তবে মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, P-টাইপ অর্ধপরিবাহী সামগ্রিকভাবে তড়িৎ নিরপেক্ষ থাকে।

N-টাইপ অর্ধপরিবাহী: গঠন ও কার্যপ্রণালী

N-টাইপ(Negative Type) অর্ধপরিবাহী তৈরি করতে বিশুদ্ধ অর্ধপরিবাহীর সাথে পঞ্চযোজী (Pentavalent) অপদ্রব্য মেশানো হয়।

ডোপিং প্রক্রিয়া

বিশুদ্ধ সিলিকন বা জার্মেনিয়ামের সাথে আর্সেনিক (As), অ্যান্টিমনি (Sb), বা ফসফরাস (P)-এর মতো পঞ্চযোজী মৌল অপদ্রব্য হিসেবে মেশানো হয়। এই অপদ্রব্যগুলিকে দাতা অপদ্রব্য (Donor Impurity) বলা হয়।

পঞ্চযোজী মৌলের পাঁচটি যোজন ইলেকট্রনের মধ্যে চারটি ইলেকট্রন পার্শ্ববর্তী সিলিকন পরমাণুর সাথে সমযোজী বন্ধন তৈরি করে। পঞ্চম ইলেকট্রনটি খুব সামান্য শক্তি গ্রহণ করে মুক্ত ইলেকট্রন হিসেবে আচরণ করে।

পঞ্চযোজী অপদ্রব্য + \(\text{Ge/Si}\) \(\rightarrow\) N-টাইপ অর্ধপরিবাহী+ মুক্ত ইলেকট্রন

আধান বাহক (Charge Carriers)

N-টাইপ অর্ধপরিবাহীতে, মুক্ত ইলেকট্রনের সংখ্যা হোলের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি থাকে।

  • সংখ্যাগুরু আধান বাহক (Majority Carrier): মুক্ত ইলেকট্রন (ঋণাত্মক চার্জবাহী)।
  • সংখ্যালঘু আধান বাহক (Minority Carrier): হোল (ধনাত্মক চার্জবাহী)।

N-টাইপ অর্ধপরিবাহীও সামগ্রিকভাবে তড়িৎ নিরপেক্ষ থাকে।

P-N জাংশন এবং ডায়োড

ইলেকট্রনিক্সের মৌলিক কাঠামো তৈরির জন্য P-টাইপ এবং N-টাইপ অর্ধপরিবাহী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন একটি P-টাইপ অর্ধপরিবাহী খণ্ডকে একটি N-টাইপ অর্ধপরিবাহী খণ্ডের সঙ্গে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করা হয়, তখন সংযোগকারী তলকে P-N জাংশন বলা হয়। এই P-N জাংশনই হলো একটি ডায়োড

P-N জাংশন তৈরি হওয়ার সাথে সাথে জাংশনের আশেপাশে সংখ্যাগুরু বাহকগুলির ব্যাপন (Diffusion) ঘটে। ফলে জাংশন তলের উভয় পাশে একটি আধান-মুক্ত অঞ্চল তৈরি হয়, যাকে অবক্ষয় স্তর (Depletion Layer) বলে। এই স্তর ডায়োডের মূল বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে।

ট্রানজিস্টর: আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের মেরুদণ্ড

আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ট্রানজিস্টর। এটি একটি অর্ধপরিবাহী ডিভাইস যা ইলেকট্রনিক সংকেতকে বিবর্ধিত (Amplify) করতে এবং সুইচ হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। ১৯৪৮ সালে এটি আবিষ্কার হওয়ার পর ইলেকট্রনিক্স জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে।

ট্রানজিস্টরের গঠন

ট্রানজিস্টর হলো মূলত তিনটি অর্ধপরিবাহী স্তরকে একত্রে যুক্ত করে তৈরি একটি তিন-প্রান্তবিশিষ্ট ডিভাইস। এর তিনটি প্রধান অংশ হলো:

  1. নিঃসারক (Emitter, E): এটি সবচেয়ে বেশি ডোপিং করা হয় এবং এটি সংখ্যাগুরু বাহক নিঃসরণ করে।
  2. পীঠ (Base, B): এটি মাঝের অংশ, যা খুব পাতলা এবং সামান্য ডোপিং করা হয়।
  3. সংগ্রাহক (Collector, C): এটি সবচেয়ে পুরু অংশ, যা নিঃসারক থেকে আসা আধান বাহক সংগ্রহ করে। এর ডোপিং নিঃসারকের চেয়ে কম হয়।

ট্রানজিস্টরের প্রকারভেদ: NPN এবং PNP

গঠনগতভাবে ট্রানজিস্টর দুই প্রকারের হয়, যা বাইপোলার জাংশন ট্রানজিস্টর (BJT) নামে পরিচিত:

১. NPN ট্রানজিস্টর

এই ট্রানজিস্টরে দুটি N-টাইপ অর্ধপরিবাহীর মাঝে একটি P-টাইপ অর্ধপরিবাহী স্তর থাকে (N-P-N)।

  • সংখ্যাগুরু বাহক: ইলেকট্রন।
  • প্রয়োগ: এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। NPN ট্রানজিস্টরের কার্যকারিতা ইলেকট্রন প্রবাহের উপর নির্ভরশীল, যা হোলের তুলনায় দ্রুত গতিশীল।

২. PNP ট্রানজিস্টর

এই ট্রানজিস্টরে দুটি P-টাইপ অর্ধপরিবাহীর মাঝে একটি N-টাইপ অর্ধপরিবাহী স্তর থাকে (P-N-P)।

  • সংখ্যাগুরু বাহক: হোল।
  • প্রয়োগ: NPN এর তুলনায় এর ব্যবহার কিছুটা কম।

ট্রানজিস্টরের প্রধান কাজ: বিবর্ধন (Amplification)

ট্রানজিস্টরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো দুর্বল সংকেতকে শক্তিশালী করা। এই প্রক্রিয়াকে বিবর্ধন বলে। ট্রানজিস্টর সাধারণত একটি ছোট বেস কারেন্ট (\(I_B\)) ব্যবহার করে একটি বড় কালেক্টর কারেন্ট (\(I_C\)) নিয়ন্ত্রণ করে। এই কারেন্ট বিবর্ধন অনুপাতকে কারেন্ট গেইন (\(\beta\)) দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

$$\beta = \frac{I_C}{I_B}$$

একটি ট্রানজিস্টর যখন সক্রিয় অঞ্চলে (Active Region) কাজ করে, তখন এই বিবর্ধন সম্ভব হয়।

ট্রানজিস্টরের অন্যন্য ব্যবহার

  • সুইচিং: কম্পিউটার এবং অন্যান্য ডিজিটাল সার্কিটে ট্রানজিস্টর সুইচ হিসেবে কাজ করে। যখন \(I_B = 0\) (কাট-অফ), ট্রানজিস্টর বন্ধ (OFF) থাকে, এবং যখন \(I_B\) বেশি থাকে (স্যাচুরেশন), তখন এটি চালু (ON) থাকে।
  • অসিলেটর (Oscillator): এটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।
  • মেমরি চিপ: SRAM-এর মতো মেমরি চিপগুলোতে ট্রানজিস্টর ডেটা সংরক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়।

🧠 অর্ধপরিবাহী কুইজ

আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের ভিত্তি


১. নিচের কোনটি একটি বিশুদ্ধ (Intrinsic) অর্ধপরিবাহীর উদাহরণ?

২. P-টাইপ অর্ধপরিবাহীতে কোন প্রকার চার্জ বাহক প্রধান?

৩. N-টাইপ অর্ধপরিবাহীতে কোন উপাদান যোগ করা হয়?

৪. ট্রানজিস্টরের তিনটি প্রধান অংশ কী?

৫. ট্রানজিস্টরের মূল কাজ কী?


🎯 আপনার স্কোর: 0 / 5

Designed by Mostak Ahmed

উপসংহার এবং ভবিষ্যৎ

অর্ধপরিবাহী প্রযুক্তি ছাড়া আধুনিক বিশ্ব অচল। সিলিকন এবং জার্মেনিয়ামের মতো সাধারণ উপাদানকে বিশেষ প্রক্রিয়া ডোপিং এর মাধ্যমে P-টাইপ ও N-টাইপ উপাদানে পরিণত করা হয়, যা থেকে তৈরি হয় ডায়োড, ট্রানজিস্টর এবং সবথেকে জটিল ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC)।

এই প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম ডট এবং আরও উন্নত অর্ধপরিবাহী যৌগ যেমন গ্যালিয়াম নাইট্রাইড (GaN) এবং সিলিকন কার্বাইড (SiC) ইলেকট্রনিক ডিভাইসকে আরও দ্রুত, শক্তিশালী এবং শক্তি সাশ্রয়ী করে তুলবে। অর্ধপরিবাহীর জগতে প্রবেশ মানেই আধুনিক প্রযুক্তির মূল রহস্য উদ্ঘাটন করা।

এই বিষয়ে আরও জানতে চান? অথবা ট্রানজিস্টর বায়াসিং নিয়ে কোনো প্রশ্ন আছে?

মন্তব্যসমূহ