আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে বিভিন্ন বস্তুর গতিবিধি লক্ষ্য করি। সাইকেল চলছে, গাড়ি ছুটছে, পাখা ঘুরছে—এই সবকিছুই গতির উদাহরণ। কিন্তু কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি এই গতির পেছনের কারণটা কী? কেন একটি স্থির বস্তু নিজে থেকে চলতে শুরু করে না, বা একটি গতিশীল বস্তু হঠাৎ থেমে যায় না? এই সকল প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে স্যার আইজ্যাক নিউটনের যুগান্তকারী তিনটি গতিসূত্রে। এই সূত্রগুলো শুধুমাত্র বল, জড়তা এবং ভরবেগের মতো ধারণাগুলোকেই ব্যাখ্যা করে না, বরং ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স বা চিরায়ত বলবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করেছে। চলুন, এই মহাবিশ্বের চালিকাশক্তিগুলোর পেছনের বিজ্ঞানকে সহজভাবে জেনে নেওয়া যাক।
নিউটনের প্রথম সূত্র এবং জড়তার ধারণা (Inertia)
আমরা যদি একটি বইকে টেবিলের ওপর রাখি, তবে সেটি সেখানেই থেকে যায় যতক্ষণ না আমরা সেটিকে সরাই। আবার, মসৃণ মেঝেতে একটি বলকে গড়িয়ে দিলে সেটি বেশ কিছুক্ষণ চলতে থাকে। এই ঘটনাগুলো থেকে একটি মৌলিক ধারণায় আসা যায়, যা হলো জড়তা।
জড়তা কী?
প্রত্যেক বস্তু তার নিজের বর্তমান অবস্থা (স্থিতি বা গতি) বজায় রাখতে চায়। বস্তুর এই নিজস্ব অবস্থা বজায় রাখার প্রবণতা বা ধর্মকেই জড়তা বলে। জড়তা দুই প্রকার:
১. স্থিতি জড়তা (Inertia of Rest)
স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকতে চাওয়ার প্রবণতাকে স্থিতি জড়তা বলে।
![]() |
চিত্রঃ স্থিতি জড়তা |
- উদাহরণ: যখন একটি থেমে থাকা বাস হঠাৎ চলতে শুরু করে, তখন যাত্রীরা পেছনের দিকে হেলে পড়েন। এর কারণ হলো, বাসের সাথে সংযুক্ত যাত্রীর শরীরের নিচের অংশ গতিশীল হলেও শরীরের উপরের অংশ স্থিতি জড়তার কারণে স্থির থাকতে চায়। ফলে, উপরের অংশ পিছিয়ে পড়ে।
২. গতি জড়তা (Inertia of Motion)
গতিশীল বস্তু চিরকাল সুষম গতিতে সরলপথে চলতে চাওয়ার প্রবণতাকে গতি জড়তা বলে।
![]() |
চিত্রঃ গতি জড়তা |
- উদাহরণ: চলন্ত বাস হঠাৎ ব্রেক করলে যাত্রীরা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কারণ, বাস থেমে গেলেও শরীরের উপরের অংশ গতি জড়তার কারণে সামনে এগিয়ে যেতে চায়।
জড়তার এই ধর্মটি বস্তুর ভরের উপর নির্ভরশীল। যে বস্তুর ভর যত বেশি, তার জড়তাও তত বেশি। অর্থাৎ, একটি ভারী বস্তুর অবস্থার পরিবর্তন করা একটি হালকা বস্তুর চেয়ে কঠিন।
নিউটনের প্রথম সূত্র:
এই জড়তার ধারণা থেকেই নিউটনের প্রথম সূত্রটি প্রতিষ্ঠিত। সূত্রটি হলো:
![]() |
চিত্রঃ স্থির ও গতিশীল বস্তু |
"বাহ্যিক কোনো বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থিরই থাকবে এবং গতিশীল বস্তু সুষম দ্রুতিতে সরলপথে চলতে থাকবে।"
এই সূত্রটি আমাদের বলের একটি গুণগত ধারণা দেয়। বল হলো সেই বাহ্যিক কারণ, যা কোনো বস্তুর জড় অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে বা করতে চায়।
নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র: বল ও ভরবেগের সম্পর্ক
প্রথম সূত্র থেকে আমরা জানলাম যে, বস্তুর অবস্থার পরিবর্তন করতে বল প্রয়োজন। কিন্তু কতটা বল প্রয়োগ করলে বস্তুর গতির কী পরিমাণ পরিবর্তন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেয় নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র। এটি বোঝার জন্য আমাদের প্রথমে ভরবেগ (Momentum) সম্পর্কে জানতে হবে।
ভরবেগ কী? (Momentum)
কোনো গতিশীল বস্তুর ভর ও বেগের গুণফলকে তার ভরবেগ বলে। ভরবেগ বস্তুর গতির পরিমাণ নির্দেশ করে। একে \(p\) দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
\( p = mv \)
যেখানে, \(m\)= বস্তুর ভর এবং \(v\) = বস্তুর বেগ। যেহেতু বেগের দিক আছে, তাই ভরবেগও একটি ভেক্টর রাশি এবং এর দিক বেগের দিকেই হয়। এর একক হলো \(kg·m/s\)।
নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র:
দ্বিতীয় সূত্রটি ভরবেগ এবং বলের মধ্যে একটি গাণিতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। সূত্রটি হলো:
"কোনো বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার এর উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং বল যেদিকে ক্রিয়া করে, বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিকেই ঘটে।"
গাণিতিক ব্যাখ্যা ও \(F=ma\) প্রতিপাদন:
ধরা যাক, \(m\) ভরের একটি বস্তু \(u\) আদিবেগে চলছিল। \(t\) সময় ধরে \(F\) বল প্রয়োগ করায় বস্তুটির বেগ পরিবর্তিত হয়ে \(v\) হলো।
- বস্তুটির আদি ভরবেগ = \(mu\)
- বস্তুটির শেষ ভরবেগ = \(mv\)
- \(t\) সময়ে ভরবেগের পরিবর্তন = \(mv - mu\)
- সুতরাং, ভরবেগের পরিবর্তনের হার = \(\frac{mv - mu}{t}\)
আমরা জানি, ত্বরণ \(a = \frac{v - u}{t}\)। তাহলে, ভরবেগের পরিবর্তনের হার = \(m \times \frac{v - u}{t} = ma\)।
নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী, প্রযুক্ত বল \((F)\) ভরবেগের পরিবর্তনের হারের সমানুপাতিক।
অর্থাৎ, \(F \propto ma\)
বা, \(F = kma\)
(এখানে \(k\) একটি সমানুপাতিক ধ্রুবক)। বলের এককের (নিউটন) সংজ্ঞা এমনভাবে দেওয়া হয় যেন \(k\) এর মান \(1\) হয়।
সুতরাং, আমরা পাই:
\(F = ma\)
এই সমীকরণটি বলবিদ্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমীকরণ। এটি বলে যে, প্রযুক্ত বল হলো বস্তুর ভর এবং ত্বরণের গুণফলের সমান।
উদাহরণ: একটি \(60 \, N\) বল দ্বারা \(30 \, kg\) ভরের বস্তুকে ধাক্কা দিলে তার ত্বরণ হবে, \(a = \frac{F}{m} = \frac{60}{30} = 2 m/s^2\)।
নিউটনের তৃতীয় সূত্র: ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া
যখন একটি বস্তু অন্য একটি বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে, তখন দ্বিতীয় বস্তুটিও কি প্রথমটির উপর কোনো বল প্রয়োগ করে? নিউটনের তৃতীয় সূত্র এই প্রশ্নের উত্তর দেয়।
নিউটনের তৃতীয় সূত্র:
"প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে।"
এর মানে হলো, প্রকৃতিতে বল সবসময় জোড়ায় জোড়ায় ক্রিয়া করে। যদি একটি বস্তু \((P)\) অন্য একটি বস্তুর \((Q)\) উপর \(F_1\) বল প্রয়োগ করে (ক্রিয়া), তবে \(Q\) বস্তুটিও \(P\) বস্তুর উপর সমান ও বিপরীতমুখী \(F_2\) বল প্রয়োগ করবে (প্রতিক্রিয়া)।
\(F_1 = -F_2\)
এখানে ঋণাত্মক চিহ্ন দ্বারা বোঝানো হয় যে, প্রতিক্রিয়া বলের দিক ক্রিয়া বলের বিপরীত।
গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য:
- ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বলের মান সমান।
- এদের দিক পরস্পর বিপরীত।
- এরা দুটি ভিন্ন বস্তুর উপর ক্রিয়া করে।
- এরা একই সাথে ঘটে।
উদাহরণ:
- হাঁটা: হাঁটার সময় আমরা পা দিয়ে মাটির উপর তির্যকভাবে বল প্রয়োগ করি (ক্রিয়া)। মাটিও আমাদের পায়ের উপর সমান ও বিপরীতমুখী বল প্রয়োগ করে (প্রতিক্রিয়া), যার কারণে আমরা সামনে এগোতে পারি।
- নৌকা থেকে লাফ: নৌকা থেকে লাফ দিয়ে তীরে নামার সময় আরোহী নৌকার উপর পা দিয়ে বল প্রয়োগ করে (ক্রিয়া)। ফলে নৌকাটি পেছনের দিকে সরে যায়। একই সময়ে, নৌকাটিও আরোহীর উপর সমান ও বিপরীত বল প্রয়োগ করে (প্রতিক্রিয়া), যার ফলে আরোহী সামনের দিকে লাফিয়ে তীরে পৌঁছাতে পারে।
ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র (Conservation of Momentum):
নিউটনের তৃতীয় সূত্র থেকে ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র প্রতিপাদন করা যায়। একাধিক বস্তুর মধ্যে যদি শুধু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বল ছাড়া অন্য কোনো বাহ্যিক বল কাজ না করে, তবে তাদের মোট ভরবেগের কোনো পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ, সংঘর্ষের আগের মোট ভরবেগ এবং সংঘর্ষের পরের মোট ভরবেগ সমান থাকে।
\(m_1u_1 + m_2u_2 = m_1v_1 + m_2v_2\)
এখানে \(m_1\) ও \(m_2\) ভরের দুটি বস্তুর সংঘর্ষের আগের বেগ যথাক্রমে \(u_1\) ও \(u_2\) এবং সংঘর্ষের পরের বেগ যথাক্রমে \(v_1\) ও \(v_2\)। এই সূত্রটি রকেট উৎক্ষেপণ, বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া ইত্যাদি ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়।
ঘর্ষণ: একটি প্রয়োজনীয় উপদ্রব
আমরা জানি, নিউটনের প্রথম সূত্র অনুযায়ী বাহ্যিক বল ছাড়া গতিশীল বস্তু থামার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে একটি চলন্ত বল কিছুক্ষণ পর থেমে যায়। এর কারণ হলো ঘর্ষণ (Friction)।
যখন দুটি বস্তু পরস্পরের সংস্পর্শে থেকে চলতে চেষ্টা করে, তখন তাদের স্পর্শতলে গতির বিরুদ্ধে একটি বাধার সৃষ্টি হয়। এই বাধাকে ঘর্ষণ বলে, এবং এই বাধার জন্য সৃষ্ট বলকে ঘর্ষণ বল বলে।
ঘর্ষণ চার প্রকার: স্থিতি ঘর্ষণ, পিছলানো ঘর্ষণ, আবর্ত ঘর্ষণ এবং প্রবাহী ঘর্ষণ।
ঘর্ষণ কেন একটি "প্রয়োজনীয় উপদ্রব"?
ঘর্ষণ একদিকে যেমন আমাদের অনেক কাজে অপরিহার্য, তেমনই অন্যদিকে এটি অনেক সমস্যারও কারণ।
প্রয়োজনীয়তা:
- ঘর্ষণের কারণেই আমরা মাটিতে হাঁটতে পারি।
- গাড়ির চাকা রাস্তাকে আঁকড়ে ধরে চলতে পারে এবং ব্রেক করে থামতে পারে।
- কাগজে কলম দিয়ে লেখা সম্ভব হয় ঘর্ষণের জন্য।
উপদ্রব:
- যন্ত্রপাতির যন্ত্রাংশ ক্ষয় হয়ে যায়।
- গতির বিরুদ্ধে কাজ করায় শক্তির অপচয় হয়।
- ঘর্ষণের ফলে তাপ উৎপন্ন হয়ে যন্ত্র গরম হয়ে যায়।
উপসংহার
স্যার আইজ্যাক নিউটনের এই তিনটি গতিসূত্র কেবল পদার্থবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনার জন্য নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ঘটনার পেছনের কার্যকারণ ব্যাখ্যা করে। জড়তার ধারণা থেকে শুরু করে বলের পরিমাণগত পরিমাপ এবং প্রতিটি ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া—এই সবকিছুই আমাদের চারপাশের বিশ্বকে বুঝতে সাহায্য করে। এই সূত্রগুলো ছাড়া রকেট বিজ্ঞান, প্রকৌশল বা নিরাপদ ভ্রমণের মতো আধুনিক প্রযুক্তির কথা চিন্তাই করা যেত না। তাই নিউটনের সূত্রগুলো আজও পদার্থবিজ্ঞানের জগতে অটুট ভিত্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।