Home About Contact

সলিনয়েড ও তড়িৎচৌম্বক: গঠন, কার্যপ্রণালী এবং ব্যবহার - সম্পূর্ণ নির্দেশিকা

সলিনয়েডের কার্যপ্রণালী, এর প্রকারভেদ এবং দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। তড়িৎচৌম্বকের গঠন, শক্তি এবং ব্যবহারবি...

ট্রান্সজিস্টর: গঠন, কার্যপ্রণালী, প্রকারভেদ ও ব্যবহার

ট্রানজিস্টর সম্পর্কে যা যা জানতে পারবেন।

ট্রানজিস্টর কী? এর গঠন, P-N-P ও N-P-N প্রকারভেদ, কার্যপ্রণালী (অ্যাম্প্লিফায়ার ও সুইচ হিসেবে) এবং দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন।

ইলেক্ট্রনিক্সের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা পান। এই গাইড আপনাকে ট্রানজিস্টরের মূল ভিত্তি বুঝতে সাহায্য করবে।

  • গঠন ও উপাদান
  • P-N-P ও N-P-N এর পার্থক্য
  • অ্যাম্প্লিফায়ার হিসেবে কাজ
  • সুইচিং অ্যাপ্লিকেশন

১. ভূমিকা

ট্রান্সজিস্টর আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের প্রাণ এবং ভিত্তি। এই ক্ষুদ্র অর্ধপরিবাহী যন্ত্রটি গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আবিষ্কারের পর থেকে প্রযুক্তির জগতে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটিয়েছে। এটি কেবল ইলেকট্রনিক সংকেতকে বর্ধিত করে না, বরং

ডিজিটাল তথ্য প্রক্রিয়াকরণের মূল উপাদান হিসেবে সুইচিং কার্যও সম্পন্ন করে। ভ্যাকুয়াম টিউবের মতো বিশাল, বিদ্যুৎ-ক্ষয়কারী এবং স্বল্পস্থায়ী ডিভাইসের যুগকে সমাপ্ত করে, ট্রান্সজিস্টর ক্ষুদ্রাকৃতি, উচ্চ দক্ষতা এবং দীর্ঘস্থায়ী ইলেকট্রনিক ডিভাইসের জন্ম দিয়েছে। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে মহাকাশযান, সুপার কম্পিউটার থেকে শুরু করে সাধারণ দৈনন্দিন যন্ত্রপাতি—সবকিছুতেই ট্রান্সজিস্টরের উপস্থিতি অনস্বীকার্য। এই নিবন্ধে, আমরা ট্রান্সজিস্টরের আবিষ্কারের ইতিহাস, এর অভ্যন্তরীণ গঠন ও কার্যপদ্ধতি, এর বিভিন্ন প্রকারভেদ (যেমন BJT, FET, MOSFET), সার্কিটে এর ব্যবহারিক প্রয়োগ (অ্যামপ্লিফায়ার, সুইচ, অসিলেটর) এবং আধুনিক প্রযুক্তিতে এর গুরুত্বপূর্ণ গাণিতিক বিশ্লেষণসহ বিস্তারিত আলোচনা করবো। ইলেকট্রনিক্স এবং সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্সের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই উপাদানটির গভীরে প্রবেশ করে এর কর্মদক্ষতার রহস্য উন্মোচন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।

২. ট্রান্সজিস্টর কী

ট্রান্সজিস্টর শব্দটি দুটি ইংরেজি শব্দ Transfer এবং Resistor-এর সংমিশ্রণ থেকে এসেছে, যার আক্ষরিক অর্থ হলো 'পরিবর্তনশীল রোধক'। এটি এমন একটি তিন-টার্মিনাল বিশিষ্ট অর্ধপরিবাহী যন্ত্র যা একটি ইনপুট সংকেতের (সাধারণত খুব ছোট কারেন্ট বা ভোল্টেজ) নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আউটপুটে একটি বৃহত্তর বা নিয়ন্ত্রিত পরিবর্তন ঘটায়। এর তিনটি প্রধান টার্মিনাল হলো: Emitter (নিঃসারক), Base (ভূমি), এবং Collector (সংগ্রাহক)। মূল কার্যনীতি হলো, বেস টার্মিনালে প্রদত্ত একটি ছোট পরিবর্তন ইমিটার ও কালেক্টরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত বড় কারেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই ট্রান্সজিস্টরকে দুটি প্রধান ভূমিকায় ব্যবহার করা যায়: Amplifier (বর্ধক) এবং Switch (সুইচ)। Amplification মোডে এটি অ্যানালগ সিগন্যালকে শক্তিশালী করে, এবং Switching মোডে এটি ডিজিটাল লজিক সার্কিটে ON/OFF অবস্থা তৈরি করে। এটি সিলিকন বা জার্মেনিয়ামের মতো অর্ধপরিবাহী উপাদান ব্যবহার করে তৈরি হয়, যেখানে P-টাইপ এবং N-টাইপ উপাদানের সন্নিবেশ দ্বারা দুটি PN জাংশন তৈরি হয়। এই জাংশনগুলির বায়াসিং-এর মাধ্যমে এর কর্মপদ্ধতি সুনিশ্চিত হয়।

৩. ট্রান্সজিস্টরের আবিষ্কার

ট্রান্সজিস্টরের আবিষ্কার ইলেকট্রনিক্সের ইতিহাসে এক সন্ধিক্ষণ। এটি ১৯২০ এর দশকের প্রথম দিকে ক্ষেত্র-প্রভাব ট্রানজিস্টরের (FET) ধারণার প্রস্তাবনা থাকলেও, ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্ভব হয়েছিল বহু পরে। অবশেষে, ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর, আমেরিকার নিউ জার্সির মারি হিলে অবস্থিত Bell Laboratories-এ এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি সংঘটিত হয়। এই আবিষ্কারের মূল কৃতিত্ব তিন কৃতী বিজ্ঞানীর:

  1. John Bardeen (জন বার্ডিন): তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি পৃষ্ঠতলের পদার্থবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।
  2. William Shockley (উইলিয়াম শকলি): দলনেতা এবং প্রধান উদ্ভাবক, যিনি জংশন ট্রানজিস্টরের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন।
  3. Walter Brattain (ওয়াল্টার ব্র্যাটেইন): পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি প্রথম 'পয়েন্ট-কন্ট্যাক্ট' ট্রানজিস্টর তৈরি করেন।

তাদের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য, এই তিন বিজ্ঞানীকে ১৯৫৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। প্রথম দিকে, তারা 'পয়েন্ট-কন্ট্যাক্ট' ট্রান্সজিস্টর তৈরি করেন, যা আজকের প্রচলিত 'জংশন' ট্রান্সজিস্টরের পূর্বসূরী ছিল। এরপর ১৯৫১ সালে শকলি জংশন বাইপোলার ট্রানজিস্টর (BJT) নিয়ে আসেন, যা ইলেকট্রনিক শিল্পকে চিরতরে বদলে দেয়। এই আবিষ্কারের মূল লক্ষ্য ছিল ভ্যাকুয়াম টিউবের বিকল্প তৈরি করা, যা বিশাল আকারের, উচ্চ বিদ্যুত খরচ এবং দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমস্যায় জর্জরিত ছিল। ট্রান্সজিস্টর সেই সমস্যার সমাধান করে, যা আধুনিক যুগের ক্ষুদ্র ও শক্তি-সাশ্রয়ী ইলেকট্রনিক্সের ভিত্তি স্থাপন করে।

৪. ট্রান্সজিস্টরের গঠন

ট্রান্সজিস্টরের গঠন বোঝার জন্য এর অর্ধপরিবাহী প্রকৃতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। একটি ট্রান্সজিস্টর মূলত তিনটি ডোপিং-করা অর্ধপরিবাহী স্তরের সমন্বয়ে গঠিত। এই তিনটি স্তর সন্নিহিত অবস্থায় স্থাপন করা হয়, ফলে দুটি PN জাংশন তৈরি হয়। ডোপিং-এর প্রকারভেদের ওপর ভিত্তি করে ট্রান্সজিস্টরকে দুটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:

৪.১. NPN ট্রান্সজিস্টর

NPN ট্রান্সজিস্টর হলো একটি P-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর স্তর, যা দুটি N-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর স্তরের মধ্যে স্যান্ডউইচের মতো করে স্থাপন করা হয়।

  • Emitter (N): এর ডোপিং ঘনত্ব (doping concentration) সবচেয়ে বেশি। এর কাজ হলো চার্জ বাহক (NPN-এর ক্ষেত্রে ইলেকট্রন) সরবরাহ করা।
  • Base (P): এটি মাঝের স্তর। এর ডোপিং ঘনত্ব সবচেয়ে কম এবং এর পুরুত্বও সবচেয়ে কম। এটি ইমিটার থেকে কালেক্টরের দিকে চার্জ প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে।
  • Collector (N): এর ডোপিং ঘনত্ব ইমিটারের চেয়ে কম কিন্তু বেসের চেয়ে বেশি। এটি ইমিটার থেকে আসা অধিকাংশ চার্জ বাহককে সংগ্রহ করে। এটির আয়তন প্রায়শই ইমিটারের চেয়ে বড় হয়, কারণ এটি তাপ অপসারণের কাজও করে।

৪.২. PNP ট্রান্সজিস্টর

PNP ট্রান্সজিস্টর হলো একটি N-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর স্তর, যা দুটি P-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর স্তরের মধ্যে স্থাপিত হয়।

  • Emitter (P): চার্জ বাহক (PNP-এর ক্ষেত্রে হোল) সরবরাহ করে।
  • Base (N): মাঝের স্তর, চার্জ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে।
  • Collector (P): চার্জ বাহককে সংগ্রহ করে।

এই দুটি গঠনেই, ইমিটার-বেস জাংশন (E-B Junction) এবং কালেক্টর-বেস জাংশন (C-B Junction) নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জাংশন তৈরি হয়, যাদের উপযুক্ত বায়াসিং (Bias-এর প্রয়োগ) ট্রান্সজিস্টরের কার্যপদ্ধতির জন্য অত্যাবশ্যক।

৫. ট্রান্সজিস্টরের প্রতীক ও টার্মিনাল

ইলেকট্রনিক সার্কিট ডায়াগ্রামে ট্রান্সজিস্টরকে তার বিশেষ প্রতীক দ্বারা উপস্থাপন করা হয়। এই প্রতীকগুলি ট্রান্সজিস্টরের প্রকারভেদ (NPN বা PNP) এবং এর টার্মিনালগুলির কার্যকারিতা নির্দেশ করে।

৫.১. NPN ট্রান্সজিস্টরের প্রতীক

NPN-এর প্রতীকে একটি সরল রেখা থাকে যা Base-কে নির্দেশ করে এবং দুটি তির্যক রেখা থাকে যা Emitter ও Collector-কে নির্দেশ করে। গুরুত্বপূর্ণভাবে, তীর চিহ্নটি Emitter থেকে Base-এর দিকে (N \(\rightarrow\) P) বহির্গামী অবস্থায় থাকে। তীর চিহ্নটি প্রচলিত কারেন্টের (হোল প্রবাহের) দিক নির্দেশ করে। NPN-এ, কারেন্ট Emitter থেকে বাইরের দিকে প্রবাহিত হয় (অথবা ইলেকট্রন Emitter-এর দিকে প্রবাহিত হয়)।

৫.২. PNP ট্রান্সজিস্টরের প্রতীক

PNP-এর প্রতীকের গঠন NPN-এর মতোই, কিন্তু তীর চিহ্নটির দিক ভিন্ন। তীর চিহ্নটি Base থেকে Emitter-এর দিকে (P \(\rightarrow\) N) অভ্যন্তরীণ অবস্থায় থাকে। এই তীর চিহ্নটি নির্দেশ করে যে প্রচলিত কারেন্ট Emitter-এর দিকে প্রবেশ করছে।

৫.৩. টার্মিনালগুলির কার্যকারিতা

  • Emitter (E): এই টার্মিনালটি সার্কিটের ইনপুট অংশে যুক্ত থাকে এবং চার্জ বাহক সরবরাহ করে। এর কাজ হলো জাংশনে প্রবেশকারী বাহকদের 'নিঃসরণ' ঘটানো।
  • Base (B): এটি কন্ট্রোল টার্মিনাল। একটি ছোট ভোল্টেজ বা কারেন্ট বেসে প্রয়োগ করে ইমিটার থেকে কালেক্টরে প্রবাহিত বড় কারেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটি একটি 'গেট' বা 'নিয়ন্ত্রণকারী কপাটিকা' হিসেবে কাজ করে।
  • Collector (C): এটি সার্কিটের আউটপুট অংশে যুক্ত থাকে। এর প্রধান কাজ হলো বেস দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, ইমিটার থেকে আসা চার্জ বাহকদের 'সংগ্রহ' করা। এর আকার তুলনামূলকভাবে বড় হয় কারণ এটি কারেন্ট সংগ্রহ করে এবং সার্কিট থেকে তাপ অপসারিত করতে সহায়তা করে।

এই প্রতীকগুলি সার্কিট বিশ্লেষণ এবং নকশার ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

৬. ট্রান্সজিস্টরের কাজের মৌলিক ধারণা

ট্রান্সজিস্টর মূলত একটি Current Control Device হিসেবে কাজ করে। এর অপারেশন একটি সাধারণ পাইপের মধ্যে জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ইমিটার-কালেক্টর প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণকারী বেস টার্মিনালের ক্ষমতাতেই এর মূল কার্যকারিতা নিহিত।

৬.১. বায়াসিং এবং অপারেশন

একটি বাইপোলার জংশন ট্রান্সজিস্টর (BJT) কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য, এর দুটি PN জাংশনকে সঠিকভাবে বায়াস করতে হয়। এর অপারেশন মোডটি মূলত এই বায়াসিং-এর উপর নির্ভরশীল:

  • অ্যাকটিভ মোড (Amplification-এর জন্য): ইমিটার-বেস (E-B) জাংশনকে Forward Biased (সম্মুখ বায়াস) এবং কালেক্টর-বেস (C-B) জাংশনকে Reverse Biased (বিপরীত বায়াস) করা হয়। সম্মুখ বায়াসিং-এর কারণে Emitter থেকে চার্জ বাহক Base-এর দিকে দ্রুত প্রবাহিত হয়। Base-টি অত্যন্ত পাতলা এবং হালকা ডোপড হওয়ায়, এই বাহকদের বেশিরভাগই (প্রায় \(95\%\) থেকে \(99\%\)) Base-কে ভেদ করে Collector-এর দিকে চলে যায়, কারণ C-B জাংশন বিপরীত বায়াসে থাকায় একটি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয় যা বাহকদের টেনে নেয়। Base কারেন্ট (\(I_B\)) সামান্য হলেও, এটি বিশাল Collector কারেন্ট (\(I_C\)) নিয়ন্ত্রণ করে।
  • সুইচিং মোড (Cut-off এবং Saturation): যখন উভয় জাংশন বিপরীত বায়াসে থাকে, ট্রান্সজিস্টর Cut-off (বন্ধ) অবস্থায় থাকে। যখন উভয় জাংশন সম্মুখ বায়াসে থাকে, ট্রান্সজিস্টর Saturation (সম্পূর্ণ চালু) অবস্থায় থাকে। এই দুটি অবস্থাই ডিজিটাল সুইচিং-এর জন্য ব্যবহৃত হয়।

৬.২. কারেন্ট কন্ট্রোল মেকানিজম

ট্রান্সজিস্টরকে একটি Current Amplifier বলা হয় কারণ একটি ছোট বেস কারেন্ট (\(I_B\)) একটি বৃহত্তর কালেক্টর কারেন্টকে (\(I_C\)) নিয়ন্ত্রণ করে। এই সম্পর্কটি ট্রান্সজিস্টরের কারেন্ট গেইন (\(\beta\)) দ্বারা প্রকাশ করা হয়:

$$I_C = \beta I_B$$

যেখানে \(\beta\) (বিটা) হলো সাধারণ ইমিটার কারেন্ট গেইন (Common Emitter Current Gain) এবং এর মান সাধারণত \(50\) থেকে \(300\) বা তার বেশি হতে পারে। এই গেইনই প্রমাণ করে যে ট্রান্সজিস্টর কতগুণ শক্তিশালী করতে পারে। এই মৌলিক ধারণাটিই ট্রান্সজিস্টরকে সংকেত বর্ধন এবং লজিক সুইচিং-এর জন্য আদর্শ করে তোলে।

৭. এনপিএন (NPN) ও পিএনপি (PNP) ট্রান্সজিস্টর

গঠন ও কার্যপদ্ধতির দিক থেকে NPN এবং PNP ট্রান্সজিস্টর একে অপরের বিপরীত হলেও, উভয়ই ইলেকট্রনিক সার্কিটে ব্যবহৃত হয়। এদের মধ্যে প্রধান পার্থক্যগুলো সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্স এবং তাদের অপারেশনাল বায়াসিং-এর উপর নির্ভর করে।

৭.১. চার্জ বাহকের প্রকারভেদ (Charge Carriers)

  • NPN ট্রান্সজিস্টর: N-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর স্তরের সংখ্যাগরিষ্ঠ চার্জ বাহক হলো ইলেকট্রন (Electrons)। NPN-এ, Emitter থেকে Collector-এ প্রবাহটি প্রধানত ইলেকট্রন প্রবাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
  • PNP ট্রান্সজিস্টর: P-টাইপ সেমিকন্ডাক্টর স্তরের সংখ্যাগরিষ্ঠ চার্জ বাহক হলো হোল (Holes)। PNP-এ, Emitter থেকে Collector-এ প্রবাহটি প্রধানত হোল প্রবাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

৭.২. বায়াসিং ভোল্টেজের পোলারিটি

কার্যকরভাবে সক্রিয় (Active) মোডে পরিচালনার জন্য এদের বায়াসিং ভোল্টেজের পোলারিটি সম্পূর্ণ বিপরীত:

  • NPN: Emitter-Base জাংশনকে সম্মুখ বায়াস করতে Base-কে Emitter-এর তুলনায় ধনাত্মক ভোল্টেজে রাখতে হয়। Collector-Base জাংশনকে বিপরীত বায়াস করতে Collector-কে Base-এর তুলনায় ধনাত্মক ভোল্টেজে রাখতে হয়। অর্থাৎ, \(V_{CC}\) এবং \(V_{BB}\) উভয়ই সাধারণত ধনাত্মক থাকে (Ground-এর সাপেক্ষে)।
  • PNP: Emitter-Base জাংশনকে সম্মুখ বায়াস করতে Base-কে Emitter-এর তুলনায় ঋণাত্মক ভোল্টেজে রাখতে হয়। Collector-Base জাংশনকে বিপরীত বায়াস করতে Collector-কে Base-এর তুলনায় ঋণাত্মক ভোল্টেজে রাখতে হয়। অর্থাৎ, \(V_{CC}\) এবং \(V_{BB}\) উভয়ই সাধারণত ঋণাত্মক থাকে (Ground-এর সাপেক্ষে)।

৭.৩. কার্যক্ষমতা ও সুবিধা

NPN ট্রান্সজিস্টর সাধারণত PNP-এর তুলনায় বেশি ব্যবহৃত হয় এবং উচ্চ গতির কার্যক্ষমতা প্রদান করে। এর মূল কারণ হলো:

  1. উচ্চ ইলেকট্রন গতিশীলতা: ইলেকট্রনের গতিশীলতা (Mobility) হোলের গতিশীলতার তুলনায় অনেক বেশি। এর ফলে NPN ট্রান্সজিস্টর দ্রুত সুইচ করতে পারে এবং উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে ভালো কাজ করে।
  2. ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC)-এ সুবিধাজনক: CMOS প্রযুক্তিতে NPN-এর মতো ডিভাইস তৈরি করা সহজ এবং তাদের পারফরম্যান্স অপটিমাইজ করা সুবিধাজনক।

যদিও PNP-এর কিছু সার্কিট ডিজাইন সুবিধা রয়েছে (যেমন Pull-up নেটওয়ার্কে ব্যবহার), সামগ্রিকভাবে NPN হলো ইলেকট্রনিক্স শিল্পের প্রধান কর্মক্ষম ট্রান্সজিস্টর।

৮. ট্রান্সজিস্টরের কাজের তিনটি অবস্থা

ট্রান্সজিস্টরের কর্মপদ্ধতিকে মূলত তিনটি প্রধান অপারেটিং মোডে বা অবস্থায় ভাগ করা যায়। এই অবস্থাগুলি নির্ভর করে ইমিটার-বেস (E-B) এবং কালেক্টর-বেস (C-B) জাংশনের বায়াসিং অবস্থার উপর।

৮.১. কাট-অফ অঞ্চল (Cut-off Region)

জাংশন বায়াস
Emitter-Base বিপরীত বায়াস (Reverse Bias)
Collector-Base বিপরীত বায়াস (Reverse Bias)

কার্যকারিতা: এই অবস্থায় ট্রান্সজিস্টর সম্পূর্ণ বন্ধ (OFF) থাকে। উভয় জাংশন বিপরীত বায়াসে থাকার কারণে, ইমিটার থেকে বেস এবং কালেক্টরে প্রায় কোনো চার্জ বাহক প্রবাহিত হতে পারে না। ফলে কালেক্টর কারেন্ট (\(I_C\)) প্রায় শূন্য হয়। ব্যবহার: এটি ডিজিটাল সার্কিটে একটি খোলা সুইচ (Open Switch) হিসেবে কাজ করে, যা লজিক '0' (Zero) বা 'LOW' অবস্থা নির্দেশ করে।

৮.২. অ্যাকটিভ অঞ্চল (Active Region)

জাংশন বায়াস
Emitter-Base সম্মুখ বায়াস (Forward Bias)
Collector-Base বিপরীত বায়াস (Reverse Bias)

কার্যকারিতা: এটি ট্রান্সজিস্টরের সংকেত বর্ধন (Amplification)-এর জন্য আদর্শ অবস্থা। E-B জাংশন সম্মুখ বায়াসে থাকায় চার্জ বাহক ইমিটার থেকে বেসের দিকে প্রবাহিত হয়। C-B জাংশন বিপরীত বায়াসে থাকায়, শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র এই বাহকদের বেস পেরিয়ে কালেক্টরের দিকে টেনে নেয়। এই অঞ্চলে \(I_C\) সরাসরি \(I_B\) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় (\(I_C = \beta I_B\))। ব্যবহার: এই অবস্থাটি অ্যানালগ সার্কিট, যেমন অডিও অ্যামপ্লিফায়ার, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যামপ্লিফায়ার ইত্যাদিতে সংকেতকে শক্তিশালী করতে ব্যবহৃত হয়।

৮.৩. স্যাচুরেশন অঞ্চল (Saturation Region)

জাংশন বায়াস
Emitter-Base সম্মুখ বায়াস (Forward Bias)
Collector-Base সম্মুখ বায়াস (Forward Bias)

কার্যকারিতা: এই অবস্থায় ট্রান্সজিস্টর সম্পূর্ণ চালু (Fully ON) থাকে। উভয় জাংশন সম্মুখ বায়াসে থাকায়, ইমিটার থেকে কালেক্টরের দিকে কারেন্ট প্রবাহ তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়। এই সীমার পরে, বেস কারেন্ট বৃদ্ধি করলেও কালেক্টর কারেন্ট আর বাড়তে পারে না। এই অঞ্চলে \(I_C\) আর \(I_B\) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না, বরং বাহ্যিক রেজিস্ট্যান্স ও ভোল্টেজ দ্বারা সীমিত হয়। এই অবস্থায় \(V_{CE}\) (কালেক্টর-ইমিটার ভোল্টেজ) খুবই কম থাকে (সাধারণত \(0.2V\) এর কাছাকাছি)। ব্যবহার: এটি ডিজিটাল সার্কিটে একটি বন্ধ সুইচ (Closed Switch) হিসেবে কাজ করে, যা লজিক '১' (One) বা 'HIGH' অবস্থা নির্দেশ করে।

এই তিনটি অঞ্চল ট্রান্সজিস্টরের অ্যাপ্লিকেশনকে সংজ্ঞায়িত করে: অ্যাকটিভ মোড অ্যানালগ সার্কিটের জন্য এবং কাট-অফ ও স্যাচুরেশন মোড ডিজিটাল সার্কিটের জন্য।

৯. ট্রান্সজিস্টরের কর্মপদ্ধতি বিশ্লেষণ

ট্রান্সজিস্টরের কর্মপদ্ধতির সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ বাইপোলার জংশন ট্রান্সজিস্টর (BJT)-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়, যদিও ক্ষেত্র-প্রভাব ট্রানজিস্টরের (FET) কর্মপদ্ধতি ভিন্ন। NPN BJT-এর অ্যাকটিভ মোড অপারেশন বোঝার জন্য, এর দুটি প্রধান কারেন্ট প্রবাহ এবং জাংশন ভোল্টেজগুলি বিবেচনা করতে হয়।

৯.১. জাংশন ভোল্টেজ ও বায়াসিং

অ্যাকটিভ মোডের জন্য, ইমিটার-বেস (E-B) জাংশনে সম্মুখ বায়াস এবং কালেক্টর-বেস (C-B) জাংশনে বিপরীত বায়াস প্রয়োগ করা হয়।

  • E-B জাংশন: সম্মুখ বায়াসের কারণে একটি ভোল্টেজ ড্রপ হয়, যাকে \(V_{BE}\) বলা হয়। সিলিকন ট্রান্সজিস্টরের জন্য, \(V_{BE} \approx 0.7\) ভোল্ট।
  • C-B জাংশন: বিপরীত বায়াসের কারণে কালেক্টর ভোল্টেজ বেস ভোল্টেজের তুলনায় যথেষ্ট বেশি হয় (NPN-এর জন্য)।

৯.২. কারেন্ট প্রবাহ

ইমিটার টার্মিনালে মোট কারেন্ট \(I_E\) হলো ট্রান্সজিস্টরে প্রবেশকারী মোট কারেন্ট (NPN-এর জন্য)। এই \(I_E\) দুটি ভাগে বিভক্ত হয়:

১. বেস কারেন্ট (\(I_B\)): ইমিটার থেকে বেসে প্রবেশকারী ইলেকট্রনগুলির মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক বেসে থাকা হোলের সাথে রিকম্বাইন করে এবং বেস টার্মিনাল দিয়ে বাইরে চলে যায়। এই সামান্য কারেন্টই \(I_B\)।

২. কালেক্টর কারেন্ট (\(I_C\)): বেসে প্রবেশকারী বেশিরভাগ ইলেকট্রন (৯৯% এর বেশি) বেসকে ভেদ করে কালেক্টরের দিকে চলে যায়, যা \(I_C\) তৈরি করে। C-B জাংশনের বিপরীত বায়াস ক্ষেত্র এই ইলেকট্রনগুলিকে কালেক্টরের দিকে টেনে নেয়।

ট্রান্সজিস্টরের কারেন্ট সম্পর্কটি কিরচফের কারেন্ট সূত্র (KCL) অনুসরণ করে:

$$I_E = I_C + I_B \quad \text{(Kirchhoff's Current Law)}$$

৯.৩. কারেন্ট গেইন পরামিতি

ট্রান্সজিস্টরের দক্ষতা বা গেইনকে দুটি প্রধান পরামিতি দিয়ে প্রকাশ করা হয়:

১. আলফা (\(\alpha\)): কমন-বেস (Common Base) কনফিগারেশনে কারেন্ট গেইন। এটি কালেক্টর কারেন্ট এবং ইমিটার কারেন্টের অনুপাত:

$$\alpha = \frac{I_C}{I_E}$$

যেহেতু \(I_C\) সবসময় \(I_E\)-এর চেয়ে সামান্য কম, তাই \(\alpha\)-এর মান সবসময় ১-এর চেয়ে সামান্য কম হয় (সাধারণত \(0.95 \lt \alpha \lt 0.999\))।

২. বিটা (\(\beta\)): কমন-ইমিটার (Common Emitter) কনফিগারেশনে কারেন্ট গেইন। এটি কালেক্টর কারেন্ট এবং বেস কারেন্টের অনুপাত:

$$\beta = \frac{I_C}{I_B}$$

এই \(\beta\) মানটিই মূলত ট্রান্সজিস্টরের অ্যামপ্লিফিকেশন ক্ষমতা নির্দেশ করে। \(\beta\) এবং \(\alpha\)-এর মধ্যে সম্পর্কটি নিম্নরূপ:

$$\beta = \frac{\alpha}{1-\alpha}$$ এবং $$\alpha = \frac{\beta}{1+\beta}$$

এই সম্পর্কগুলো দেখায় যে বেস কারেন্টকে সামান্য নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে একটি বৃহত্তর কালেক্টর কারেন্টকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যা ট্রান্সজিস্টরের মূল কার্যনীতি।

১০. ট্রান্সজিস্টর দ্বারা বর্ধন (Amplification)

ট্রান্সজিস্টর তার অ্যাকটিভ মোড অপারেশনের মাধ্যমে অ্যানালগ সংকেতকে বর্ধিত করে। একটি অ্যামপ্লিফায়ার মূলত ছোট ইনপুট সংকেতকে (ভোল্টেজ বা কারেন্ট) আউটপুটে একটি বৃহত্তর সংস্করণে রূপান্তরিত করে। এই প্রক্রিয়াটি ট্রান্সজিস্টরের কারেন্ট কন্ট্রোল মেকানিজমের উপর ভিত্তি করে তৈরি।

১০.১. অ্যামপ্লিফিকেশনের প্রক্রিয়া

ট্রান্সজিস্টরকে একটি কমন-ইমিটার (CE) কনফিগারেশনে বায়াস করা হয় (যা সর্বাধিক ভোল্টেজ গেইন প্রদান করে)।

  1. ইনপুট সংকেত: একটি ছোট অ্যানালগ ইনপুট ভোল্টেজ \(V_{in}\) বেস-ইমিটার জাংশনে প্রয়োগ করা হয়। এটি বেস কারেন্ট (\(I_B\))-কে সামান্য পরিবর্তন করে।
  2. কারেন্ট কন্ট্রোল: যেহেতু \(I_C = \beta I_B\), বেস কারেন্টের সামান্য পরিবর্তন কালেক্টর কারেন্ট (\(I_C\))-এ \(\beta\) গুণ বেশি পরিবর্তন আনে। এই পরিবর্তনশীল কালেক্টর কারেন্ট (\(i_c\)) হলো বর্ধিত কারেন্ট সংকেত।
  3. আউটপুট ভোল্টেজ: এই পরিবর্তিত কালেক্টর কারেন্ট একটি লোড রোধক (\(R_C\)) এর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। ওহমের সূত্র (\(V=IR\)) অনুসারে, লোড রোধকের দুই প্রান্তে একটি ভোল্টেজ ড্রপ (\(V_{out}\)) তৈরি হয়: $$V_{out} = I_C R_C$$ যেহেতু \(I_C\) হল \(I_B\)-এর \(\beta\) গুণ, তাই আউটপুট ভোল্টেজের পরিবর্তন ইনপুট ভোল্টেজের পরিবর্তনের তুলনায় অনেক বেশি হয়, ফলে ভোল্টেজ অ্যামপ্লিফিকেশন সম্পন্ন হয়।

১০.২. ভোল্টেজ গেইন (\(A_v\))

অ্যামপ্লিফায়ারের কর্মদক্ষতা পরিমাপ করা হয় গেইন (Gain) দ্বারা। ভোল্টেজ গেইন (\(A_v\)) হলো আউটপুট ভোল্টেজের পরিবর্তন এবং ইনপুট ভোল্টেজের পরিবর্তনের অনুপাত:

$$A_v = \frac{\Delta V_{out}}{\Delta V_{in}}$$ $$A_v = \frac{V_{out}}{V_{in}}$$

একটি কমন-ইমিটার অ্যামপ্লিফায়ারের জন্য, ছোট সংকেত বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভোল্টেজ গেইনকে প্রায় নিম্নরূপে প্রকাশ করা যায়:

$$A_v \approx - \frac{R_C}{r'_e}$$

যেখানে \(R_C\) হলো কালেক্টর লোড রোধ এবং \(r'_e\) হলো ইমিটারের অভ্যন্তরীণ ডায়নামিক রোধ, যা তাপমাত্রা ও DC ইমিটার কারেন্টের উপর নির্ভরশীল। ঋণাত্মক চিহ্নটি নির্দেশ করে যে ইনপুট ও আউটপুট ভোল্টেজ সংকেত দুটি \(180^\circ\) দশা পার্থক্য (Phase Shift) থাকে। এই গাণিতিক সম্পর্কটি স্পষ্ট করে যে ট্রান্সজিস্টরের একটি ছোট ইনপুট সংকেতকে একটি উচ্চ গেইন দ্বারা গুণিত করে শক্তিশালী আউটপুট সংকেত তৈরি করার ক্ষমতা রয়েছে।

১১. ট্রান্সজিস্টর দ্বারা সুইচিং (Switching)

ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সের ভিত্তি হলো সুইচিং অপারেশন, যেখানে ট্রান্সজিস্টর একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং দ্রুত গতির ইলেকট্রনিক সুইচ হিসেবে কাজ করে। এই প্রক্রিয়াটি ট্রান্সজিস্টরের দুটি চরম অপারেটিং অবস্থার (Cut-off এবং Saturation) উপর ভিত্তি করে তৈরি।

১১.১. ON/OFF অপারেশন

একটি ইলেকট্রনিক সুইচ হিসেবে ট্রান্সজিস্টরের দুটি অবস্থা থাকে:

১. OFF অবস্থা (Cut-off Region): যখন ইনপুট সিগন্যাল (বেস ভোল্টেজ) শূন্য বা \(0.7V\) (সিলিকনের জন্য) এর নিচে থাকে, তখন ইমিটার-বেস জাংশন সম্মুখ বায়াস পায় না। ট্রান্সজিস্টর কাট-অফ মোডে চলে যায়।

  • কালেক্টর কারেন্ট (\(I_C\)) প্রায় শূন্য (\(I_C \approx 0\))।
  • কালেক্টর-ইমিটার ভোল্টেজ (\(V_{CE}\)) সর্বোচ্চ সাপ্লাই ভোল্টেজ (\(V_{CC}\)) এর সমান হয় (\(V_{CE} \approx V_{CC}\))।
  • এই অবস্থাটি খোলা সুইচ (Open Switch) বা লজিক '0' (LOW) নির্দেশ করে।

২. ON অবস্থা (Saturation Region): যখন ইনপুট সিগন্যাল একটি পর্যাপ্ত উচ্চ ভোল্টেজে (যা ট্রান্সজিস্টরকে সক্রিয় করার জন্য প্রয়োজনীয়) পৌঁছায়, তখন বেস কারেন্ট (\(I_B\)) এত বেশি হয় যে ট্রান্সজিস্টর স্যাচুরেশন মোডে চলে যায়।

  • কালেক্টর কারেন্ট (\(I_C\)) লোড রেসিস্টর এবং সাপ্লাই ভোল্টেজ দ্বারা নির্ধারিত তার সর্বোচ্চ মানে পৌঁছায় (\(I_{C(sat)} = \frac{V_{CC}}{R_C}\)।
  • কালেক্টর-ইমিটার ভোল্টেজ (\(V_{CE}\)) প্রায় শূন্য হয় (\(V_{CE(sat)} \approx 0.2V\))।
  • এই অবস্থাটি বন্ধ সুইচ (Closed Switch) বা লজিক '১' (HIGH) নির্দেশ করে।

১১.২. ডিজিটাল লজিক গেটে ব্যবহার

এই সুইচিং ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সমস্ত মৌলিক ডিজিটাল লজিক গেট (AND, OR, NOT, NAND, NOR) তৈরি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি সাধারণ ইনভার্টার বা NOT গেট একটিমাত্র ট্রান্সজিস্টর ব্যবহার করে তৈরি করা যায়। যখন ইনপুটে HIGH (Saturation) দেওয়া হয়, আউটপুট LOW (Cut-off) হয়, এবং বিপরীতভাবে।

ট্রান্সজিস্টরের সুইচিং ক্ষমতা আধুনিক কম্পিউটিং এবং ডেটা প্রসেসিং-এর মূল ভিত্তি। একটি একক ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটে লক্ষ লক্ষ এই ধরনের ক্ষুদ্র সুইচ ব্যবহার করে জটিল লজিক ফাংশন এবং মেমরি উপাদান তৈরি করা হয়।

১২. ট্রান্সজিস্টরের গাণিতিক সম্পর্ক

ট্রান্সজিস্টর সার্কিটের ডিজাইন ও বিশ্লেষণ সম্পূর্ণরূপে তার কারেন্ট, ভোল্টেজ এবং রেজিস্ট্যান্সের মধ্যেকার গাণিতিক সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। এই সম্পর্কগুলি মূলত কিরচফের সূত্র এবং ডিভাইসের কারেন্ট গেইন পরামিতি থেকে উদ্ভূত।

১২.১. কারেন্ট সম্পর্ক (Current Relationships)

ট্রান্সজিস্টরের প্রধান কারেন্ট সম্পর্ক হলো কিরচফের কারেন্ট সূত্র (KCL) অনুসারে:

$$I_E = I_C + I_B$$

যেখানে \(I_E\) হলো ইমিটার কারেন্ট, \(I_C\) কালেক্টর কারেন্ট এবং \(I_B\) বেস কারেন্ট।

অ্যাকটিভ মোডে কালেক্টর কারেন্টের সঙ্গে বেস কারেন্টের সম্পর্ক, যা কারেন্ট গেইন \(\beta\) দ্বারা নির্ধারিত:

$$I_C = \beta I_B$$

এই দুটি সূত্র একত্রিত করে ইমিটার কারেন্টের সাথে অন্যান্য কারেন্টের সম্পর্ক তৈরি করা যায়:

$$I_E = I_C + \frac{I_C}{\beta} = I_C \left( 1 + \frac{1}{\beta} \right) = I_C \frac{\beta + 1}{\beta}$$

ইমিটার কারেন্টকে কারেন্ট গেইন \(\alpha\) ব্যবহার করেও প্রকাশ করা যায়, যেখানে \(\alpha = \frac{I_C}{I_E}\):

$$I_C = \alpha I_E$$

$$\beta = \frac{\alpha}{1-\alpha}$$

এবং

$$I_E = I_C + I_B = \alpha I_E + I_B \implies I_B = I_E (1-\alpha)$$

এই গাণিতিক সম্পর্কগুলি DC বায়াসিং এবং AC সংকেত বিশ্লেষণ উভয় ক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১২.২. ডিসি লোড লাইন (DC Load Line)

একটি কমন-ইমিটার কনফিগারেশনে DC বিশ্লেষণ করার জন্য, কালেক্টর-ইমিটার লুপে কিরচফের ভোল্টেজ সূত্র (KVL) প্রয়োগ করা হয়। একটি সাধারণ সার্কিটে, সাপ্লাই ভোল্টেজ (\(V_{CC}\)), কালেক্টর রোধক (\(R_C\)) এবং কালেক্টর-ইমিটার ভোল্টেজ (\(V_{CE}\))-এর মধ্যে সম্পর্ক নিম্নরূপ:

$$V_{CC} = I_C R_C + V_{CE}$$

এই সমীকরণটিকে পুনর্বিন্যাস করলে একটি সরলরেখার সমীকরণ পাওয়া যায়, যা 'ডিসি লোড লাইন' নামে পরিচিত:

$$I_C = -\frac{1}{R_C} V_{CE} + \frac{V_{CC}}{R_C}$$

এই রেখাটি কালেক্টর ক্যারেক্টারিস্টিক কার্ভের উপর অঙ্কন করা হয়। এই রেখার দুটি প্রান্তিক বিন্দু গুরুত্বপূর্ণ:

১. Cut-off Point (\(I_C=0\)): $$V_{CE} = V_{CC}$$

২. Saturation Point (\(V_{CE}=0\)): $$I_C = \frac{V_{CC}}{R_C}$$

অ্যামপ্লিফিকেশনের জন্য ট্রান্সজিস্টরকে ডিসি লোড লাইনের মাঝামাঝি একটি বিন্দুতে (Q-point বা Quiescent Point) বায়াস করা হয়। এই গাণিতিক কাঠামো সার্কিটের কর্মক্ষমতা এবং ডিজাইন সীমাবদ্ধতা নির্ধারণের জন্য অপরিহার্য।

১৩. ট্রান্সজিস্টরের বৈশিষ্ট্য রেখাচিত্র (Characteristic Curves)

ট্রান্সজিস্টরের কর্মক্ষমতা বোঝার জন্য এর ইনপুট এবং আউটপুট বৈশিষ্ট্য রেখাচিত্রগুলি (Characteristic Curves) বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রাফগুলি ভোল্টেজ এবং কারেন্টের মধ্যে সম্পর্ক দেখায় এবং এর অপারেটিং অঞ্চলগুলি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে।

১৩.১. কমন-ইমিটার ইনপুট বৈশিষ্ট্য রেখাচিত্র (Common Emitter Input Characteristics)

এই রেখাচিত্রটি বেস-ইমিটার ভোল্টেজ (\(V_{BE}\)) বনাম বেস কারেন্ট (\(I_B\))-এর সম্পর্ক দেখায়, যেখানে কালেক্টর-ইমিটার ভোল্টেজ (\(V_{CE}\)) স্থির রাখা হয়।

  • আকৃতি: এই কার্ভটি একটি আদর্শ PN জাংশন ডায়োডের সম্মুখ বায়াস বৈশিষ্ট্য রেখাচিত্রের অনুরূপ।
  • বিশ্লেষণ: \(V_{BE}\) প্রায় \(0.7V\) (সিলিকনের জন্য) না হওয়া পর্যন্ত \(I_B\) প্রায় শূন্য থাকে। \(V_{BE}\) এই থ্রেশহোল্ড ভোল্টেজ অতিক্রম করার পর \(I_B\) দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন \(V_{CE}\) মানের জন্য কার্ভগুলি সামান্য ভিন্ন হয়, যা বেস-উইডথ মডুলেশন (Early Effect) নির্দেশ করে।

১৩.২. কমন-ইমিটার আউটপুট বৈশিষ্ট্য রেখাচিত্র (Common Emitter Output Characteristics)

এটি ট্রান্সজিস্টরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রেখাচিত্র। এটি কালেক্টর-ইমিটার ভোল্টেজ (\(V_{CE}\)) বনাম কালেক্টর কারেন্ট (\(I_C\))-এর সম্পর্ক দেখায়, যেখানে বেস কারেন্ট (\(I_B\)) একটি নির্দিষ্ট ধ্রুবক মানে স্থির রাখা হয়।

  • Cut-off Region: \(I_B = 0\) রেখা বরাবর, \(I_C\) প্রায় শূন্য। এই অঞ্চলটি সুইচিং-এর OFF অবস্থাকে নির্দেশ করে।
  • Active Region: এই অঞ্চলটি \(V_{CE}\) অক্ষের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। এই অঞ্চলে \(I_C\) প্রায় ধ্রুবক থাকে এবং এটি সরাসরি \(I_B\) দ্বারা নির্ধারিত হয় (\(I_C = \beta I_B\))। প্রতিটি ভিন্ন \(I_B\) মানের জন্য একটি করে সমান্তরাল রেখা পাওয়া যায়। অ্যামপ্লিফিকেশনের জন্য এই অঞ্চলটি ব্যবহৃত হয়।
  • Saturation Region: এই অঞ্চলটি \(V_{CE}\) অক্ষের কাছাকাছি বাঁ দিকে অবস্থিত। এই অঞ্চলে \(V_{CE}\) খুব কম থাকে (\(V_{CE(sat)} \approx 0.2V\)) এবং \(I_C\) খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই অঞ্চলটি সুইচিং-এর ON অবস্থাকে নির্দেশ করে।

১৩.৩. Early Effect (আর্লি এফেক্ট)

আউটপুট কার্ভে দেখা যায় যে অ্যাকটিভ অঞ্চলে \(I_C\) সম্পূর্ণরূপে ধ্রুবক থাকে না; \(V_{CE}\) বাড়লে \(I_C\) সামান্য বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হলো: \(V_{CE}\) বাড়লে কালেক্টর-বেস জাংশনের ডিপ্লেশন অঞ্চলের প্রস্থ বাড়ে, ফলে বেসের কার্যকর প্রস্থ কমে যায়। একে বেস-উইডথ মডুলেশন (Base-Width Modulation) বা আর্লি এফেক্ট বলা হয়। এটি ডিভাইসের কারেন্ট গেইন এবং আউটপুট রোধকে প্রভাবিত করে। এই রেখাচিত্রগুলি সার্কিট ডিজাইনারদেরকে একটি নির্দিষ্ট বায়াসিং অবস্থায় ট্রান্সজিস্টরের আচরণ বুঝতে এবং অপারেটিং কিউ-পয়েন্ট (Q-point) সঠিকভাবে সেট করতে সাহায্য করে।

১৪. ট্রান্সজিস্টরের প্রকারভেদ

ট্রান্সজিস্টর মূলত দুটি বড় পরিবারে বিভক্ত: বাইপোলার জংশন ট্রান্সজিস্টর (BJT) এবং ফিল্ড ইফেক্ট ট্রানজিস্টর (FET)। এদের গঠন, কার্যপদ্ধতি এবং বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আরও বিভিন্ন উপ-শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।

১৪.১. বাইপোলার জংশন ট্রান্সজিস্টর (BJT)

BJT-তে কারেন্ট প্রবাহ দুটি ধরনের চার্জ বাহক (ইলেকট্রন এবং হোল) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই একে বাইপোলার বলা হয়।

  • NPN: সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহক ইলেকট্রন। সাধারণত উচ্চ গতি এবং কার্যক্ষমতার জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়।
  • PNP: সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহক হোল। সাধারণত পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট সার্কিটে বা বিশেষ পুল-আপ/পুল-ডাউন নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত হয়।
  • বৈশিষ্ট্য: BJT একটি Current Controlled Device। অর্থাৎ, একটি ছোট বেস কারেন্ট (\(I_B\)) একটি বৃহত্তর কালেক্টর কারেন্ট (\(I_C\))-কে নিয়ন্ত্রণ করে। BJT উচ্চ কারেন্ট পরিচালনার জন্য উপযুক্ত কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম ইনপুট ইম্পিডেন্স থাকে।

১৪.২. ফিল্ড এফেক্ট ট্রানজিস্টর (FET)

FET-এ কারেন্ট প্রবাহ একটিমাত্র ধরনের চার্জ বাহক (হয় ইলেকট্রন, অথবা হোল) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই একে ইউনিপোলার বলা হয়। FET একটি Voltage Controlled Device। অর্থাৎ, গেট টার্মিনালে প্রয়োগ করা একটি ভোল্টেজ সোর্স (Source) এবং ড্রেন (Drain)-এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কারেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করে। FET-এর ইনপুট ইম্পিডেন্স BJT-এর তুলনায় অনেক বেশি, যা এটিকে ভোল্টেজ অ্যামপ্লিফিকেশনের জন্য আদর্শ করে তোলে।

১৪.২.১. জংশন ফিল্ড এফেক্ট ট্রানজিস্টর (JFET)

এটি একটি PN জাংশন ব্যবহার করে চ্যানেলের প্রশস্ততা পরিবর্তন করে কারেন্ট নিয়ন্ত্রণ করে। এর দুটি প্রকার:

  • N-চ্যানেল JFET: ইলেকট্রন প্রধান বাহক।
  • P-চ্যানেল JFET: হোল প্রধান বাহক।

১৪.২.২. মেটাল অক্সাইড সেমিকন্ডাক্টর ফিল্ড এফেক্ট ট্রানজিস্টর (MOSFET)

এটি আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডিভাইস। গেট এবং চ্যানেলকে একটি পাতলা সিলিকন ডাই অক্সাইড (\(SiO_2\)) স্তরের মাধ্যমে বৈদ্যুতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়, যার ফলে এর ইনপুট ইম্পিডেন্স অত্যন্ত বেশি হয়।

  • Enhancement Type (eMOSFET): গেট ভোল্টেজ প্রয়োগ না করলে এটি OFF থাকে। CMOS প্রযুক্তিতে এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
  • Depletion Type (dMOSFET): গেট ভোল্টেজ শূন্য হলেও এটি ON থাকে। গেট ভোল্টেজ দ্বারা এটিকে OFF করা যায়।
  • বৈশিষ্ট্য: MOSFET-গুলি অত্যন্ত কম পাওয়ার ক্ষয় করে এবং উচ্চ ঘনত্বে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটে (IC) তৈরি করা যায়, যা আধুনিক প্রসেসর ও মেমরির ভিত্তি।

আধুনিক কম্পিউটিং ডিভাইসগুলিতে বেশিরভাগই MOSFET ব্যবহৃত হয়, তবে BJT এখনও কিছু নির্দিষ্ট পাওয়ার ইলেকট্রনিক্স এবং অ্যানালগ অ্যাপ্লিকেশনে ব্যবহৃত হয়।

১৫. ট্রান্সজিস্টরের ব্যবহার

ট্রান্সজিস্টরের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে, যা এটিকে আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের অপরিহার্য উপাদান করে তুলেছে। এর প্রধান প্রয়োগগুলি নিচে আলোচনা করা হলো।

১৫.১. অ্যামপ্লিফায়ার (Amplifier)

ট্রান্সজিস্টরের অ্যাকটিভ মোড অপারেশনকে কাজে লাগিয়ে অ্যামপ্লিফায়ার তৈরি করা হয়, যা একটি ছোট ইনপুট সংকেতের শক্তি বা ভোল্টেজকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে।

  • অডিও অ্যামপ্লিফায়ার: রেডিও, টিভি এবং মিউজিক সিস্টেমে মাইক্রোফোন বা অন্যান্য অডিও সোর্স থেকে প্রাপ্ত দুর্বল সংকেতকে স্পিকার চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিশালী সংকেতে রূপান্তর করে।
  • রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (RF) অ্যামপ্লিফায়ার: ওয়্যারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থায় ট্রান্সমিশন এবং রিসিভিং-এর সময় সংকেতকে শক্তিশালী করতে ব্যবহৃত হয়।
  • পাওয়ার অ্যামপ্লিফায়ার: উচ্চ ক্ষমতার আউটপুট প্রদানের জন্য ডিজাইন করা হয় (যেমন: স্পিকার বা মোটরের জন্য)।

১৫.২. সুইচ (Switch)

ট্রান্সজিস্টরের কাট-অফ এবং স্যাচুরেশন মোড ব্যবহার করে সুইচিং ফাংশন সম্পন্ন করা হয়।

  • ডিজিটাল লজিক গেট: কম্পিউটার, ক্যালকুলেটর এবং ডিজিটাল সিস্টেমে লজিক ফাংশন (AND, OR, NOT) তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।
  • রিলে ড্রাইভ সার্কিট: কম ভোল্টেজের ডিজিটাল সংকেত ব্যবহার করে উচ্চ ভোল্টেজের বা উচ্চ কারেন্টের লোড (যেমন রিলে, মোটর, বাতি) নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহৃত হয়।
  • মেমরি সেল: SRAM (Static Random Access Memory) মেমরি সেলে ডেটা স্টোর করার জন্য ট্রান্সজিস্টর সুইচ হিসেবে কাজ করে।

১৫.৩. অসিলেটর (Oscillator)

অসিলেটর হলো এমন একটি ইলেকট্রনিক সার্কিট যা DC পাওয়ারকে একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির AC সিগন্যালে (সাধারণত সাইন ওয়েভ বা স্কোয়ার ওয়েভ) রূপান্তরিত করে। অসিলেটর তৈরি করতে ট্রান্সজিস্টর একটি অ্যাকটিভ ডিভাইস হিসেবে কাজ করে, যা আউটপুট থেকে ইনপুটে ফিডব্যাক প্রদান করে।

  • ব্যবহার: ঘড়ি সংকেত (Clock Signal) জেনারেশন, রেডিও ট্রান্সমিটার এবং রিসিভারের ফ্রিকোয়েন্সি তৈরি, ফাংশন জেনারেটর ইত্যাদি। (যেমন: Colpitts Oscillator, Hartley Oscillator)।

১৫.৪. ভোল্টেজ রেগুলেটর (Voltage Regulator)

ট্রান্সজিস্টর একটি সিরিজ বা শান্ট রেগুলেটর হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা ইনপুট ভোল্টেজের পরিবর্তন বা লোড কারেন্টের পরিবর্তন সত্ত্বেও আউটপুটে একটি স্থির ভোল্টেজ বজায় রাখে। জেনার ডায়োডের সাথে মিলিত হয়ে এটি স্থিতিশীল পাওয়ার সাপ্লাই নিশ্চিত করে।

১৫.৫. মডুলেটর এবং ডি-মডুলেটর

ওয়্যারলেস যোগাযোগে ট্রান্সজিস্টর অ্যামপ্লিফিকেশন এবং সুইচিং ক্ষমতার মাধ্যমে সংকেতের মডুলেশন (তথ্যকে ক্যারিয়ার ওয়েভে লোড করা) এবং ডি-মডুলেশন (তথ্যকে ক্যারিয়ার ওয়েভ থেকে আলাদা করা) প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।

সংক্ষেপে, ট্রান্সজিস্টর কেবল একটি উপাদান নয়; এটি আধুনিক ইলেকট্রনিক্স, তথ্য প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ এবং স্বয়ংক্রিয়তার কেন্দ্রবিন্দু।

১৬. ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটে ট্রান্সজিস্টরের ভূমিকা

ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC), যা চিপ নামেও পরিচিত, হলো আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন। এটি মূলত সিলিকনের একটি ছোট খণ্ড বা চিপের উপর বহু সংখ্যক ট্রান্সজিস্টর, ডায়োড, রোধক এবং ধারক একীভূত করার প্রক্রিয়া। IC-তে ট্রান্সজিস্টরের ভূমিকা এতটাই মৌলিক যে এটি ছাড়া কোনো আধুনিক ডিজিটাল বা জটিল অ্যানালগ সার্কিট তৈরি করা সম্ভব নয়।

১৬.১. ক্ষুদ্রাকৃতি ও ঘনত্ব (Miniaturization and Density)

ট্রান্সজিস্টরের আবিষ্কারের পর থেকেই এর আকার ক্রমাগত ছোট হতে শুরু করে। ১৯৫৮ সালে প্রথম IC তৈরির সময় এতে মাত্র কয়েকটি ট্রান্সজিস্টর ছিল। আজকের আধুনিক মাইক্রোপ্রসেসর (যেমন Intel, AMD প্রসেসর)-এ কোটি কোটি (বিলিয়ন) ট্রান্সজিস্টর থাকে। এই প্রবণতাটি মুর'স ল (Moore's Law) দ্বারা বর্ণনা করা হয়, যা বলে যে একটি চিপে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা প্রতি দুই বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়। এই ক্ষুদ্রাকৃতির কারণে:

  • ডিভাইসের কার্যক্ষমতা (Performance) বৃদ্ধি পায়।
  • বিদ্যুৎ খরচ (Power Consumption) হ্রাস পায়।
  • উত্পাদন খরচ (Cost) কমে আসে।

১৬.২. লজিক গেট এবং মেমরি

IC-এর মূল কাজ হলো তথ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণ করা, যা ট্রান্সজিস্টর দ্বারা নির্মিত লজিক গেট এবং মেমরি সেলের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

  • লজিক গেট: একটি প্রসেসরের ALU (Arithmetic Logic Unit) সহ সমস্ত ডিজিটাল লজিক সার্কিট মৌলিক NOT, NAND, NOR গেট ব্যবহার করে তৈরি হয়। প্রতিটি গেট তৈরি হয় কয়েকটি সুইচিং ট্রান্সজিস্টর ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, CMOS প্রযুক্তিতে একটি NAND গেট দুটি PMOS এবং দুটি NMOS ট্রান্সজিস্টর ব্যবহার করে তৈরি হয়।
  • মেমরি: কম্পিউটার মেমরির দুটি প্রধান প্রকার হলো SRAM (Static Random Access Memory) এবং DRAM (Dynamic Random Access Memory)। SRAM-এর প্রতিটি মেমরি সেল (যা ১ বিট ডেটা সংরক্ষণ করে) সাধারণত ৬টি MOSFET ট্রান্সজিস্টর ব্যবহার করে তৈরি হয়। অন্যদিকে, DRAM একটি ক্যাপাসিটরের সাথে ১টি MOSFET ব্যবহার করে, যা প্রতি বিট ডেটার জন্য উচ্চ ঘনত্ব প্রদান করে।

১৬.৩. CMOS প্রযুক্তি

আধুনিক ডিজিটাল IC-এর সিংহভাগ কমপ্লিমেন্টারি মেটাল অক্সাইড সেমিকন্ডাক্টর (CMOS) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি হয়। এই প্রযুক্তিতে P-চ্যানেল (PMOS) এবং N-চ্যানেল (NMOS) MOSFET-গুলিকে সম্মিলিতভাবে ব্যবহার করা হয়। CMOS-এর প্রধান সুবিধা হলো:

  • কম পাওয়ার ক্ষয়: স্থিতিশীল অবস্থায় (ON বা OFF), CMOS গেটগুলিতে বিদ্যুৎ প্রবাহ প্রায় থাকেই না, যার ফলে পাওয়ার লস অনেক কম হয়।
  • উচ্চ নয়েজ মার্জিন: এটি বাইরের নয়েজ সংকেত সহ্য করতে সক্ষম।

ট্রান্সজিস্টর IC-এর মধ্যে কেবল সুইচ বা অ্যামপ্লিফায়ার হিসেবেই নয়, বরং ক্যাপাসিটর, রোধক বা ডায়োডের ফাংশনও অনুকরণ করতে পারে। এই বহুমুখীতাই IC-কে এতো শক্তিশালী করে তুলেছে।

১৭. ট্রান্সজিস্টরের পরীক্ষণ ও সংযোগ পদ্ধতি

একটি ট্রান্সজিস্টরকে ব্যবহার করার আগে তার কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা এবং সার্কিটে সঠিকভাবে সংযোগ করা অপরিহার্য।

১৭.১. মাল্টিমিটার দ্বারা পরীক্ষণ

বাইপোলার জংশন ট্রান্সজিস্টর (BJT) দুটি ডায়োড দ্বারা গঠিত: ইমিটার-বেস ডায়োড এবং কালেক্টর-বেস ডায়োড। একটি মাল্টিমিটারের ডায়োড টেস্টিং মোড ব্যবহার করে এই জাংশনগুলি পরীক্ষা করা যায়।

  1. বেস টার্মিনাল সনাক্তকরণ: বেস টার্মিনাল হলো সেই সাধারণ টার্মিনাল যার সাথে অন্যান্য দুটি টার্মিনালের (ইমিটার ও কালেক্টর) জাংশন তৈরি হয়।
  2. NPN পরীক্ষণ:
    • লাল প্রোব বেসে এবং কালো প্রোব ইমিটার বা কালেক্টরে রাখলে মাল্টিমিটার একটি ফরওয়ার্ড বায়াস ডায়োডের মতো কম ভোল্টেজ ড্রপ দেখাবে (প্রায় \(0.6-0.7V\))।
    • প্রোব উল্টো করলে (বিপরীত বায়াস) এটি একটি ওপেন সার্কিট দেখাবে।
  3. PNP পরীক্ষণ:
    • কালো প্রোব বেসে এবং লাল প্রোব ইমিটার বা কালেক্টরে রাখলে এটি একটি ফরওয়ার্ড বায়াস ডায়োডের মতো কম ভোল্টেজ ড্রপ দেখাবে।
    • প্রোব উল্টো করলে এটি একটি ওপেন সার্কিট দেখাবে।
  4. ভালো/ত্রুটিপূর্ণ: যদি উভয় জাংশনই ফরওয়ার্ড বা রিভার্স বায়াসে শর্ট বা ওপেন দেখায়, তবে ট্রান্সজিস্টরটি সম্ভবত ত্রুটিপূর্ণ।

১৭.২. ট্রান্সজিস্টর বায়াসিং (Biasing)

কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য ট্রান্সজিস্টরকে তার অপারেটিং অঞ্চলে (যেমন অ্যাকটিভ মোড) স্থাপন করা প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়াটিকে বায়াসিং বলা হয়, যা DC ভোল্টেজ ও কারেন্ট প্রয়োগ করে সম্পন্ন হয়। প্রধান বায়াসিং কনফিগারেশনগুলি হলো:

  1. ফিক্সড বায়াস (Fixed Bias): সবচেয়ে সরল, কিন্তু তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে Q-পয়েন্ট (অপারেটিং পয়েন্ট) স্থিতিশীল থাকে না।
  2. ইমিটার ফিডব্যাক বায়াস (Emitter Feedback Bias): ইমিটার রোধক (\(R_E\)) যোগ করে থার্মাল স্থিতিশীলতা (Thermal Stability) উন্নত করা হয়।
  3. ভোল্টেজ ডিভাইডার বায়াস (Voltage Divider Bias): সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং স্থিতিশীল পদ্ধতি। দুটি রোধক ব্যবহার করে বেসে একটি স্থির ভোল্টেজ তৈরি করা হয়, যা তাপমাত্রা পরিবর্তন বা \(\beta\) মান পরিবর্তন হলেও Q-পয়েন্টকে স্থির রাখতে সাহায্য করে। এই স্থিতিশীলতা একটি অ্যামপ্লিফায়ার সার্কিটের সঠিক অপারেশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৭.৩. কমন কনফিগারেশন (Common Configurations)

সার্কিটে সংযোগের উপর ভিত্তি করে BJT-এর তিনটি প্রধান কনফিগারেশন রয়েছে:

  1. কমন ইমিটার (Common Emitter - CE): সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অ্যামপ্লিফায়ার কনফিগারেশন। এটি উচ্চ ভোল্টেজ গেইন, উচ্চ কারেন্ট গেইন এবং ইনপুট ও আউটপুট সংকেতে \(180^\circ\) দশা পার্থক্য প্রদান করে।
  2. কমন কালেক্টর (Common Collector - CC) বা ইমিটার ফলোয়ার (Emitter Follower): এর ভোল্টেজ গেইন প্রায় ১, কিন্তু উচ্চ কারেন্ট গেইন রয়েছে। এটি উচ্চ ইনপুট ইম্পিডেন্স এবং নিম্ন আউটপুট ইম্পিডেন্স প্রদান করে, যা ইম্পিডেন্স ম্যাচিং-এর জন্য আদর্শ।
  3. কমন বেস (Common Base - CB): এর কারেন্ট গেইন প্রায় ১, কিন্তু এটি উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি অপারেশনের জন্য এবং ইম্পিডেন্স ম্যাচিং-এর জন্য ব্যবহৃত হয়।

১৮. ট্রান্সজিস্টরের সীমাবদ্ধতা

ট্রান্সজিস্টর আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের ভিত্তি হলেও, এর কিছু মৌলিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে যা সার্কিট ডিজাইনারদেরকে বিবেচনা করতে হয়।

১৮.১. তাপমাত্রা সংবেদনশীলতা (Temperature Sensitivity)

ট্রান্সজিস্টর অর্ধপরিবাহী উপাদান দিয়ে তৈরি হওয়ায়, এর কার্যক্ষমতা তাপমাত্রার উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।

  • থার্মাল রানওয়ে (Thermal Runaway): তাপমাত্রা বাড়লে কালেক্টর কারেন্ট (\(I_C\)) বৃদ্ধি পায়। এই বর্ধিত কারেন্ট ডিভাইসটিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে, যা \(I_C\)-কে আরও বাড়িয়ে দেয়। যদি এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে এটি ডিভাইসটিকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই সমস্যাটি কাটিয়ে ওঠার জন্য বায়াসিং সার্কিটে তাপমাত্রা স্থিতিশীল করার ব্যবস্থা রাখা হয় (যেমন: ভোল্টেজ ডিভাইডার বায়াস)।
  • পরামিতির পরিবর্তন: ট্রান্সজিস্টরের কারেন্ট গেইন (\(\beta\)) এবং বেস-ইমিটার ভোল্টেজ (\(V_{BE}\)) তাপমাত্রার সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়।

১৮.২. ফ্রিকোয়েন্সি সীমাবদ্ধতা (Frequency Limitation)

ট্রান্সজিস্টরের জাংশনগুলিতে স্বাভাবিকভাবেই ক্যাপাসিট্যান্স (ধারকত্ব) তৈরি হয়, যাকে জাংশন ক্যাপাসিট্যান্স বলা হয়।

  • উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিতে, এই অভ্যন্তরীণ ক্যাপাসিট্যান্সগুলি সংকেতের সাথে প্যারালাল শর্ট সার্কিট হিসেবে কাজ করে, যা অ্যামপ্লিফায়ারের গেইনকে দ্রুত কমিয়ে দেয়।
  • BJT-এর ক্ষেত্রে, এটি ট্রানজিশন ফ্রিকোয়েন্সি (\(f_T\)) দ্বারা সীমিত হয়। \(f_T\) হলো সেই ফ্রিকোয়েন্সি যেখানে কমন-ইমিটার কারেন্ট গেইন unity ($1$) হয়ে যায়।

১৮.৩. নয়েজের প্রভাব (Noise Effect)

ট্রান্সজিস্টর ইলেকট্রনিক সংকেত বর্ধন করার সময়, সংকেতের সাথে অবাঞ্ছিত বৈদ্যুতিক গোলমাল বা নয়েজও যুক্ত করে।

  • শট নয়েজ (Shot Noise): চার্জ বাহকদের (ইলেকট্রন ও হোল) র‍্যান্ডম প্রবাহের কারণে এই নয়েজ তৈরি হয়।
  • থার্মাল নয়েজ (Thermal Noise): রোধক এবং অন্যান্য উপাদানের মধ্যে তাপীয় আন্দোলনের কারণে এই নয়েজ তৈরি হয়।
  • উচ্চ সংবেদনশীল অ্যামপ্লিফায়ারগুলিতে (যেমন RF রিসিভার), এই নয়েজ সংকেতকে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিতে পারে।

১৮.৪. পাওয়ার হ্যান্ডলিং এবং ব্রেকডাউন (Power Handling and Breakdown)

ট্রান্সজিস্টরের একটি সর্বোচ্চ পাওয়ার ক্ষয় সীমা ($P_{D(max)}$) থাকে। এই সীমা অতিক্রম করলে ডিভাইসটি অতিরিক্ত গরম হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও, উচ্চ ভোল্টেজ প্রয়োগের ফলে জাংশন ব্রেকডাউন হতে পারে (যেমন: কালেক্টর-বেস জাংশন ব্রেকডাউন ভোল্টেজ), যা ডিভাইসের স্থায়ী ক্ষতি করে।

১৯. আধুনিক প্রযুক্তিতে ট্রান্সজিস্টরের উন্নয়ন

ট্রান্সজিস্টরের আবিষ্কারের পর থেকে এর নির্মাণশৈলী এবং উপাদান প্রযুক্তিতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের চাহিদা মেটাতে ট্রান্সজিস্টরগুলি আরও ক্ষুদ্র, দ্রুত এবং শক্তি-সাশ্রয়ী হয়েছে।

১৯.১. ন্যানো-স্কেল প্রযুক্তি

আজকের প্রসেসরগুলিতে ট্রান্সজিস্টরের গেট দৈর্ঘ্য ন্যানোমিটার (nm) স্কেলে চলে এসেছে (যেমন: \(5\)nm বা \(3\)nm)। এই ক্ষুদ্রাকৃতি সম্ভব হয়েছে উন্নত ফটো-লিথোগ্রাফি এবং সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাব্রিকেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে। তবে, এই ন্যানো-স্কেলে প্রচলিত প্ল্যানার (planar) ট্রান্সজিস্টরগুলি শারীরিক সীমাবদ্ধতায় পৌঁছায়, যার মধ্যে অন্যতম হলো লিকেজ কারেন্ট এবং শর্ট-চ্যানেল এফেক্ট।

১৯.২. ফিনএফইটি (FinFET - Fin Field-Effect Transistor)

প্ল্যানার ট্রান্সজিস্টরের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার জন্য FinFET প্রযুক্তির আগমন ঘটে।

  • গঠন: FinFET-এ চ্যানেলের গঠন একটি মাছের পাখনা (Fin)-এর মতো হয়। গেটটি চ্যানেলের তিনটি দিক (উপরে, বামে এবং ডানে) ঘিরে থাকে, যা চ্যানেলটিকে আরও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
  • সুবিধা: এই ট্রাই-গেট (Tri-Gate) গঠন লিকেজ কারেন্টকে নাটকীয়ভাবে হ্রাস করে এবং সুইচিং গতি ও পাওয়ার দক্ষতা বৃদ্ধি করে। আজকের ইন্টেল, এএমডি এবং অ্যাপলের মতো সংস্থাগুলির প্রসেসরগুলি FinFET বা এর উন্নত সংস্করণ ব্যবহার করে।

১৯.৩. CMOS এবং উন্নত লিথোগ্রাফি

আধুনিক ডিজিটাল সার্কিটগুলি CMOS (Complementary MOS) প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে। উচ্চতর ঘনত্ব এবং পারফরম্যান্স অর্জনের জন্য, চরম আল্ট্রাভায়োলেট (EUV) লিথোগ্রাফির মতো উন্নত ফ্যাব্রিকেশন কৌশল ব্যবহার করা হয়, যা ন্যানো-স্কেলে নির্ভুল প্যাটার্নিং সম্ভব করে তোলে।

১৯.৪. গেট-অল-অ্যারাউন্ড (GAA) এবং ন্যানোশিট

FinFET-এর পরেও যখন আরও ছোট স্কেলে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন গেট-অল-অ্যারাউন্ড (Gate-All-Around - GAA) ট্রানজিস্টর এবং ন্যানোশিট (Nanosheet) প্রযুক্তির কথা আসে। GAA-তে, গেট চ্যানেলকে সম্পূর্ণরূপে চারিদিক থেকে ঘিরে রাখে, যা চ্যানেল নিয়ন্ত্রণকে আরও অপটিমাইজ করে এবং লিকেজ কারেন্টকে আরও কমিয়ে দেয়। এটি বর্তমানে উন্নত উৎপাদন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

১৯.৫. কোয়ান্টাম ডট এবং কার্বন ন্যানোটিউব

ভবিষ্যতের প্রযুক্তি গবেষণায়, গবেষকরা সিলিকনের পরিবর্তে কোয়ান্টাম ডট এবং কার্বন ন্যানোটিউব (CNT)-এর মতো বিকল্প উপাদান ব্যবহার করে ট্রান্সজিস্টর তৈরির চেষ্টা করছেন, যা তাত্ত্বিকভাবে সিলিকন-ভিত্তিক ডিভাইসের চেয়ে বেশি গতি এবং কম শক্তি খরচ করতে পারে।

২০. সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর

  1. ট্রান্সজিস্টরের তিনটি টার্মিনালের নাম লিখুন।
  2. উত্তর: ইমিটার (Emitter), বেস (Base), এবং কালেক্টর (Collector)।

  3. Amplification-এর গাণিতিক সম্পর্ক কী?
  4. উত্তর: ভোল্টেজ অ্যামপ্লিফিকেশনের গাণিতিক সম্পর্ক হলো আউটপুট ভোল্টেজ (\(V_{out}\)) এবং ইনপুট ভোল্টেজ (\(V_{in}\)) এর অনুপাত:

    $$A_v = \frac{V_{out}}{V_{in}}$$

  5. PNP ও NPN ট্রান্সজিস্টরের প্রধান পার্থক্য লিখুন।
  6. উত্তর: PNP ট্রান্সজিস্টরের সংখ্যাগরিষ্ঠ চার্জ বাহক হলো হোল (Holes), আর NPN ট্রান্সজিস্টরের সংখ্যাগরিষ্ঠ চার্জ বাহক হলো ইলেকট্রন (Electrons)। এছাড়াও, NPN-এর কাজের জন্য ধনাত্মক বায়াসিং ভোল্টেজ এবং PNP-এর জন্য ঋণাত্মক বায়াসিং ভোল্টেজ প্রয়োজন।

  7. ট্রান্সজিস্টরের তিনটি প্রধান কাজের অঞ্চল (Region of Operation) কী কী?
  8. উত্তর: কাট-অফ (Cut-off), অ্যাকটিভ (Active) এবং স্যাচুরেশন (Saturation) অঞ্চল।

  9. একটি বাইপোলার জংশন ট্রান্সজিস্টর (BJT) কি ধরনের ডিভাইস?
  10. উত্তর: BJT হলো একটি Current Controlled Device

  11. একটি Field Effect Transistor (FET) কি ধরনের ডিভাইস?
  12. উত্তর: FET হলো একটি Voltage Controlled Device

  13. কমন-ইমিটার কনফিগারেশনে ইনপুট এবং আউটপুট সংকেতের মধ্যে দশা পার্থক্য (Phase Shift) কত?
  14. উত্তর: \(180^\circ\) (বা \(\pi\) রেডিয়ান)।

  15. ট্রান্সজিস্টরের কারেন্ট গেইন বিটা (\(\beta\)) এর গাণিতিক সংজ্ঞা কী?
  16. উত্তর: কালেক্টর কারেন্ট (\(I_C\)) এবং বেস কারেন্ট (\(I_B\)) এর অনুপাত:

    $$\beta = \frac{I_C}{I_B}$$

  17. আধুনিক প্রসেসরে প্ল্যানার ট্রান্সজিস্টরের পরিবর্তে কোন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে?
  18. উত্তর: ফিনএফইটি (FinFET)।

২১. উপসংহার

ট্রান্সজিস্টর আধুনিক সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর। গত আট দশক ধরে এই ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী ডিভাইসটি ইলেকট্রনিক্স, তথ্য প্রযুক্তি, যোগাযোগ এবং অটোমেশন শিল্পে অবিচ্ছিন্নভাবে বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। এর আবিষ্কার ভ্যাকুয়াম টিউবের মতো দুর্বল প্রযুক্তিকে প্রতিস্থাপন করে আমাদের জন্য ক্ষুদ্রাকৃতির, দ্রুত এবং শক্তি-সাশ্রয়ী ডিজিটাল যুগের দরজা খুলে দিয়েছে। BJT-এর কারেন্ট কন্ট্রোল ক্ষমতা হোক বা FET এবং MOSFET-এর উচ্চ ইনপুট ইম্পিডেন্স এবং ভোল্টেজ কন্ট্রোল মেকানিজম—প্রত্যেকটি প্রকারভেদই নির্দিষ্ট প্রয়োগের জন্য অপরিহার্য। অ্যামপ্লিফিকেশনের মাধ্যমে দুর্বল সংকেতকে শক্তিশালী করা থেকে শুরু করে সুইচিং-এর মাধ্যমে জটিল ডিজিটাল লজিক এবং মেমরি ফাংশন সম্পন্ন করা পর্যন্ত, ট্রান্সজিস্টরের বহুমুখী কার্যকারিতা অনস্বীকার্য। গাণিতিক মডেলিং, বৈশিষ্ট্য রেখাচিত্র বিশ্লেষণ এবং সঠিক বায়াসিং-এর মাধ্যমে ট্রান্সজিস্টরের কর্মক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করা যায়। প্রযুক্তির ক্রমাগত অগ্রগতির সাথে সাথে ন্যানো-স্কেলে FinFET এবং GAA-এর মতো উদ্ভাবনী কাঠামো তৈরি হচ্ছে, যা মুর'স ল-কে বজায় রেখে ট্রিলিয়ন-ট্রান্সজিস্টর চিপের দিকে আমাদের চালিত করছে। ইলেকট্রনিক্স ও সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্সের শিক্ষার্থীদের জন্য, ট্রান্সজিস্টরের গঠন, কার্যপদ্ধতি এবং এর গাণিতিক বিশ্লেষণ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন অত্যাবশ্যক। এটি কেবল তাত্ত্বিক ধারণা নয়, বরং বাস্তবিক সার্কিট ডিজাইনের মূল ভিত্তি, যা আগামী দিনের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পথ তৈরি করবে।