সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর: গতি, শক্তি ও ভরবেগ | পদার্থবিজ্ঞান সমাধান

পদার্থবিজ্ঞানের বল ও গতি, শক্তি এবং ভরবেগ সম্পর্কিত একটি উদ্দীপক বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এই পোস্টটি লেখা হয়েছে। এই সৃজনশীল প্রশ্নগুলো সমাধানের মাধ্যমে আপনি গতিশক্তি ও ভরবেগের সম্পর্ক এবং শক্তির নিত্যতা সূত্রের ব্যবহার শিখতে পারবেন।

  • উদ্দীপকটি পড়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে :

\(0.5 \, kg\) ভরের একটি বস্তুকে \(88 \, ms^{-1}\) বেগে খাড়া উপরের দিকে ছোড়া হলো। এটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠে আবার পড়ন্ত বস্তুর ন্যায় মুক্তভাবে ভূমিতে পতিত হলো।

ক. শক্তির রূপান্তর কী?

খ. গতিশক্তি ও ভরবেগের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন কর।

গ. বস্তুটি ছুড়ে মারার 3 s পর গতিশক্তি কত হবে?

ঘ.দেখাও যে, ভূমি হতে 40 m উপরে বস্তুটির যান্ত্রিক শক্তি ভূমিকে স্পর্শ করার মুহূর্তের গতিশক্তির সমান

যে বিষয়গুলোতে আপনার পারদর্শিতা প্রয়োজন, সেগুলোর বিস্তারিত আগে আলোচনা করা হলো:

​বল ও গতি (Force and Motion)

​পদার্থবিজ্ঞানের এই শাখাটি মূলত কোনো বস্তুর উপর বল প্রয়োগের ফলে তার গতির কী ধরনের পরিবর্তন হয়, তা নিয়ে কাজ করে। এখানে নিউটনের গতির সূত্রগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

  • গতির সমীকরণ: কোনো বস্তুর প্রাথমিক বেগ (u), শেষ বেগ (v), ত্বরণ (a), সরণ (s) এবং সময় (t) এর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনকারী কিছু মৌলিক সমীকরণ রয়েছে। যেমন:
    • ​\(v = u + at\) (সময় সাপেক্ষে বেগের পরিবর্তন)
    • \(​s = ut + \frac{1}{2}at^2\) (সময় সাপেক্ষে সরণের পরিবর্তন)
    • \(​v^2 = u^2 + 2as\) (সরণের সাপেক্ষে বেগের পরিবর্তন) এই সমীকরণগুলো ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠতে বা একটি নির্দিষ্ট সময় পর বস্তুর বেগ ও অবস্থান নির্ণয় করা যায়।

​শক্তি (Energy)

​শক্তি হলো কাজ করার সামর্থ্য। পদার্থবিজ্ঞানে বিভিন্ন ধরনের শক্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়, তবে এই প্রশ্নগুলোর জন্য প্রধানত গতিশক্তি এবং বিভব শক্তি বোঝা জরুরি।

  • গতিশক্তি (Kinetic Energy): কোনো গতিশীল বস্তুর তার গতির জন্য যে শক্তি থাকে, তাকে গতিশক্তি বলে। এর সূত্র হলো: \(E_k = \frac{1}{2}mv^2,\) যেখানে m হলো বস্তুর ভর এবং v হলো তার বেগ।
  • বিভব শক্তি (Potential Energy): কোনো বস্তুর অবস্থান বা অবস্থার কারণে যে শক্তি সঞ্চিত হয়, তাকে বিভব শক্তি বলে। মহাকর্ষীয় বিভব শক্তির সূত্র হলো: \(E_p = mgh,\) যেখানে m হলো ভর, g হলো অভিকর্ষজ ত্বরণ এবং h হলো উচ্চতা।
  • শক্তির রূপান্তর: শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হতে পারে। যেমন, একটি বলকে যখন উপরের দিকে ছোড়া হয়, তখন তার গতিশক্তি ধীরে ধীরে বিভব শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আবার, যখন এটি নিচে পড়তে শুরু করে, তখন বিভব শক্তি গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। মোট যান্ত্রিক শক্তি (গতিশক্তি + বিভব শক্তি) যদি কোনো বাইরের বল দ্বারা প্রভাবিত না হয়, তাহলে তা সর্বদা সংরক্ষিত থাকে।

​ভরবেগ (Momentum)

​কোনো বস্তুর ভরবেগ হলো তার ভর এবং বেগের গুণফল। একে p দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এর সূত্র হলো: \(p = mv\)। ভরবেগের দিক বেগের দিকের সমান। গতিশক্তি এবং ভরবেগের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, যা হলো: \(E_k = \frac{p^2}{2m}\)। এই সূত্রটি ব্যবহার করে গতিশক্তি থেকে ভরবেগ বা ভরবেগ থেকে গতিশক্তি নির্ণয় করা যায়।

​এই ধারণাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারলে সৃজনশীল প্রশ্নগুলো সমাধান করা সহজ হবে।

প্রদত্ত প্রশ্নগুলোর সমাধান

প্রদত্ত তথ্য: একটি বস্তুর ভর: m = 0.5 kg প্রারম্ভিক বেগ: u = 88 m/s অভিকর্ষজ ত্বরণ: g = 9.8 m/s²

ক) শক্তির রূপান্তর কী?

শক্তির রূপান্তর হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। ⚡️ এই রূপান্তরের সময় শক্তির মোট পরিমাণ সর্বদা অপরিবর্তিত থাকে, যা শক্তির নিত্যতা সূত্র বা Conservation of Energy-এর মূল নীতি।

খ) গতিশক্তি ও ভরবেগের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন কর।

আমরা জানি, গতিশক্তির সূত্র: \(E_k = \frac{1}{2}mv^2\)

ভরবেগের সূত্র: \(p = mv\) 

ভরবেগের সূত্র থেকে পাই, 
\(v = \frac{p}{m}\)।
এখন, v-এর এই মানটি গতিশক্তির সূত্রে বসিয়ে পাই: 
\(E_k = \frac{1}{2}m(\frac{p}{m})^2\) 

\(E_k = \frac{1}{2}m(\frac{p^2}{m^2}) \) 

\(E_k = \frac{p^2}{2m}\) 

সুতরাং, কোনো বস্তুর গতিশক্তি তার ভরবেগের বর্গের সমানুপাতিক এবং ভরের ব্যস্তানুপাতিক।

গ) বস্তুটি ছুঁড়ে মারার 3 s পর গতিশক্তি কত হবে?

প্রথমে, 3 সেকেন্ড পর বস্তুর বেগ কত হবে তা নির্ণয় করতে হবে। অভিকর্ষের অধীনে গতির প্রথম সূত্র ব্যবহার করে পাই:

\(v = u - gt\) (উপরের দিকে গতির জন্য ত্বরণ ঋণাত্মক) 

\(v = 88 - (9.8 \times 3) \) 

\(v = 88 - 29.4 \) 

\(v = 58.6 \, m/s\) 

এখন, এই বেগ ব্যবহার করে গতিশক্তি নির্ণয় করি: \(E_k = \frac{1}{2}mv^2 \) 

\(E_k = \frac{1}{2} \times 0.5 \times (58.6)^2 \) 

\(E_k = 0.25 \times 3433.96 \) 

\(E_k = 858.49 \, J\) 

সুতরাং, 3 সেকেন্ড পর বস্তুর গতিশক্তি হবে 858.49 J।

ঘ) দেখাও যে, ভূমি হতে 40 মিটার উপরে বস্তুটির যান্ত্রিক শক্তি ভূমিকে স্পর্শ করার মুহূর্তের গতিশক্তির সমান।

শক্তির নিত্যতা সূত্র অনুযায়ী, কোনো বস্তুর মোট যান্ত্রিক শক্তি (গতিশক্তি + বিভব শক্তি) সর্বদা ধ্রুব থাকে, যদি বাইরের কোনো বল কাজ না করে।

ভূমি থেকে 40 মিটার উপরে যান্ত্রিক শক্তি \((E_{mech}):\) 

প্রথমে, 40 মিটার উচ্চতায় বস্তুর বেগ নির্ণয় করি। গতির তৃতীয় সূত্র ব্যবহার করে পাই: 

\(v^2 = u^2 - 2gh \) 

\(v^2 = (88)^2 - 2 \times 9.8 \times 40 \) 

\(v^2 = 7744 - 784\)   

\(v^2 = 6960\) 

এখন, 40 মিটার উচ্চতায় গতিশক্তি \((E_k)\) এবং বিভব শক্তি \((E_p)\) নির্ণয় করি: 

\(E_k = \frac{1}{2}mv^2 = \frac{1}{2} \times 0.5 \times 6960 = 1740 \, J \) 

\(E_p = mgh = 0.5 \times 9.8 \times 40 = 196 \, J\) 

সুতরাং, 40 মিটার উচ্চতায় মোট যান্ত্রিক শক্তি: \(E_{mech} = E_k + E_p = 1740 + 196 = 1936 \, J\) 

ভূমিতে স্পর্শ করার মুহূর্তের গতিশক্তি \((E_{final}):\) 

ভূমির উপরে বস্তুর প্রাথমিক যান্ত্রিক শক্তি এবং ভূমিতে আঘাত করার মুহূর্তের যান্ত্রিক শক্তি সমান হবে। 

শক্তির নিত্যতা সূত্র অনুযায়ী: 

প্রাথমিক যান্ত্রিক শক্তি \((E_{initial})\) = ভূমিতে আঘাত করার মুহূর্তের গতিশক্তি \((E_{final})\) 

প্রাথমিক যান্ত্রিক শক্তি \((E_{initial})\) = প্রাথমিক গতিশক্তি + প্রাথমিক বিভব শক্তি 

যেহেতু বস্তুটি ভূমি থেকে ছোঁড়া হয়েছিল, তাই প্রাথমিক বিভব শক্তি শূন্য। 

\(E_{initial} = \frac{1}{2}mu^2 + 0\) 

\(E_{initial} = \frac{1}{2} \times 0.5 \times (88)^2 \) 

\(E_{initial} = 0.25 \times 7744 \) 

\(E_{initial} = 1936 \, J\) 

যেহেতু ভূমিতে আঘাত করার মুহূর্তে উচ্চতা শূন্য, তাই বিভব শক্তিও শূন্য হবে। 

 অর্থাৎ, ওই মুহূর্তে মোট যান্ত্রিক শক্তি সম্পূর্ণরূপে গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হবে। 

সুতরাং, ভূমিতে স্পর্শ করার মুহূর্তের গতিশক্তি 

\((E_{final}) = E_{initial} = 1936 \, J।\) 

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ভূমি থেকে 40 মিটার উপরে বস্তুটির যান্ত্রিক শক্তি ভূমিকে স্পর্শ করার মুহূর্তের গতিশক্তির সমান।

উপসংহার

​এই উদ্দীপকটি পদার্থবিজ্ঞানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণাকে একত্রিত করে: বল ও গতি, শক্তি এবং ভরবেগ। আমরা দেখেছি কীভাবে গতির সমীকরণ ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট সময় পর বস্তুর বেগ নির্ণয় করা যায় এবং সেই বেগ থেকে গতিশক্তি হিসাব করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমরা শক্তির নিত্যতা সূত্র প্রয়োগ করে প্রমাণ করেছি যে, কোনো ঘর্ষণজনিত বল না থাকলে, একটি বস্তুর মোট যান্ত্রিক শক্তি তার যাত্রাপথে সর্বদা অপরিবর্তিত থাকে। এটি আমাদের দেখায় যে, একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় মোট শক্তি এবং ভূমিতে আঘাত করার মুহূর্তের মোট শক্তি (যা সম্পূর্ণরূপে গতিশক্তি) সমান হয়। এই বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত এবং বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে সহায়ক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন