তড়িৎ প্রবাহের চৌম্বক প্রভাব, ওয়েরস্টেডের পরীক্ষা, সলিনয়েড, মোটর, জেনারেটর ও ট্রান্সফরমারসহ বৈদ্যুতিক ও চৌম্বকীয় অধ্যায়ের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা। শিক্ষার্থীদের জন্য সুন্দরভাবে সাজানো বাংলা ওয়েবসাইট কনটেন্ট।
🔹 ভূমিকা
- স্থির তড়িৎ আধানের চারপাশে একটি তড়িৎ ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়।
- কিন্তু যখন কোনো পরিবাহীর মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ ঘটে, তখন তার চারপাশে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়।
- এই ঘটনাকে বলা হয়: তড়িৎ প্রবাহের চৌম্বক প্রভাব।
✨ অন্যান্য প্রভাবের তুলনায় চৌম্বক প্রভাব কেন গুরুত্বপূর্ণ?
- তড়িৎ প্রবাহের ফলে তাপীয় ও রাসায়নিক ক্রিয়া ঘটতে পারে।
- তবে চৌম্বকীয় প্রভাব সবসময় ঘটে, এবং এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
⚙️ বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
- ফ্যান
- মোটর
- জেনারেটর
- ➡️ এরা সকলেই এই নীতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে।
📚 ইতিহাস
- প্রথম আবিষ্কার করেন: হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়েরস্টেড (১৮২০)
- দেশ: ডেনমার্ক (কোপেনহেগেন)
- তার সম্মানে চৌম্বক ক্ষেত্রের একক: Oersted
🎯 এই অধ্যায়ে আপনি শিখবেন:
- সলিনয়েড কেন দণ্ড চুম্বকের মতো আচরণ করে
- তড়িৎ প্রবাহে চুম্বকীয় আবেশ
- মোটর ও জেনারেটরের কার্যপ্রণালী
- ট্রান্সফরমারের ব্যবহার
🔹ওয়েরস্টেডের পরীক্ষা (Oersted’s Experiment)
🧪 পরীক্ষার উপকরণ ও পদ্ধতি:
- একটি অনুভূমিকভাবে ঘূর্ণনক্ষম চৌম্বক শলাকা (NS)
- একটি তড়িৎবাহী পরিবাহী তার (AB), যা শলাকার সমান্তরালে রাখা হয়
- পর্যবেক্ষণ: তড়িৎ প্রবাহ চালু হলে শলাকাটি ঘুরে যায়
🧲 পরীক্ষার প্রধান পর্যবেক্ষণ:
- তড়িৎ প্রবাহ চালু করলে চুম্বক শলাকা ঘোরে এবং পরিবাহীর সাথে সমকোণে অবস্থান করতে চায়
- প্রবাহের মাত্রা বাড়ালে বিক্ষেপ কোণও বাড়ে (কিন্তু ৯০° বা তার বেশি নয়)
- প্রবাহের দিক পাল্টালে শলাকার বিক্ষেপের দিকও পাল্টায়
- পরিবাহী শলাকার নিচে রাখলে বিক্ষেপ আবার বিপরীত দিকে ঘটে
- শলাকার সাথে সমকোণে পরিবাহী রাখলে কোনো বিক্ষেপ হয় না
📌 সিদ্ধান্ত (Conclusion):
- তড়িৎ প্রবাহের কারণে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়
- চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রাবল্য নির্ভর করে প্রবাহের পরিমাণের উপর
- চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক নির্ভর করে প্রবাহের দিকের উপর
- যদি কোনো বিক্ষেপ না ঘটে, তবে সৃষ্ট ক্ষেত্র ভূ-চৌম্বক ক্ষেত্রের সমান্তরাল
তড়িৎ ও চৌম্বক বিদ্যুৎ
অ্যাম্পিয়ারের সন্তরণ সূত্র (Ampere’s Swimming Rule)
📘 সূত্র
- যদি কেউ কোনো পরিবাহীর সমান্তরালে তড়িৎ প্রবাহের দিক বরাবর সাঁতার কাটে, এবং তার মাথা ও চুম্বক শলাকার উত্তর মেরু একই দিকে থাকে,
- তাহলে তার বাঁ হাত যেদিকে বিক্ষিপ্ত হবে, চুম্বক শলাকার উত্তর মেরুও সেদিকে বিক্ষিপ্ত হবে।
🔹 সলিনয়েড ও এর চৌম্বক ক্ষেত্র (Solenoid and Magnetic Field)
🔩 সলিনয়েড কী?
- স্প্রিং-এর মতো ঘনসন্নিবিষ্টভাবে পেঁচানো অন্তরিত পরিবাহী তারকে সলিনয়েড বলে।
- সলিনয়েডের প্রতিটি পাক চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে।
- সমগ্র সলিনয়েডের চৌম্বক ক্ষেত্র তাই অনেক বেশি প্রবল হয়।
⚡ প্রাবল্য বৃদ্ধির উপায়:
- প্রতি একক দৈর্ঘ্যে পাক সংখ্যা বাড়ালে
- তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ বাড়ালে
- লোহার দণ্ড প্রবেশ করালে (তাড়িতচুম্বক তৈরি হয়)
🔹 তাড়িতচৌম্বক আবেশ (Electromagnetic Induction)
📜 ফ্যারাডের আবিষ্কার
- ১৮৩১ সালে মাইকেল ফ্যারাডে দেখান যে, চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের ফলে কুণ্ডলীতে তড়িৎ প্রবাহ আবিষ্ট হয়।
- এই ঘটনাকে বলা হয়: তাড়িতচৌম্বক আবেশ
🧪 পরীক্ষা:
- দণ্ড চুম্বককে কুণ্ডলীর কাছে আনা বা সরালে গ্যালভানোমিটারের সূচ বিক্ষিপ্ত হয়।
- চুম্বক ও কুণ্ডলীর মধ্যে আপেক্ষিক গতি না থাকলে তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয় না।
📚 ফ্যারাডের সূত্র
- প্রথম সূত্র: চৌম্বক বলরেখার সংখ্যা পরিবর্তিত হলে তাড়িতচৌম্বক আবেশ ঘটে।
- দ্বিতীয় সূত্র: আবিষ্ট তড়িচ্চালক শক্তি, বলরেখার সংখ্যার পরিবর্তনের হারের ঋণাত্মক মানের সমানুপাতিক।
🔹 তড়িৎ মোটর ও জেনারেটর (Electric Motor and Generator)
⚙️ তড়িৎ মোটর (Electric Motor)
- তড়িৎ শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে
- মূল উপাদান: ক্ষেত্র চুম্বক, আর্মেচার, কম্যুটেটর, ব্রাশ
- ফ্লেমিং-এর বাম হস্ত নিয়ম দ্বারা বলের দিক নির্ধারণ করা হয়
🔄 গতি বাড়ানোর উপায়:
- তড়িৎ প্রবাহ বাড়ানো
- কুণ্ডলীর পাক সংখ্যা ও ক্ষেত্রফল বাড়ানো
- শক্তিশালী চুম্বক ব্যবহার
🔌 জেনারেটর (Generator)
- যান্ত্রিক শক্তিকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তর করে
- ফ্যারাডের তাড়িতচৌম্বক আবেশের নীতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে
- AC ও DC — দুই ধরনের জেনারেটর রয়েছে
🔹 ট্রান্সফরমার (Transformer)
📐 ট্রান্সফরমারের কাজ
- বিভব কমানো বা বাড়ানো, তবে শক্তি অপরিবর্তিত থাকে
- AC প্রবাহে কাজ করে
- মূলত তাড়িতচৌম্বক আবেশের নীতির ভিত্তিতে তৈরি
🔺 দুই ধরনের ট্রান্সফরমার:
- স্টেপ আপ: গৌণ কুণ্ডলীর পাক সংখ্যা বেশি
- স্টেপ ডাউন: মুখ্য কুণ্ডলীর পাক সংখ্যা বেশি
🔢 গাণিতিক সম্পর্ক:
- \(\frac{E_{s}}{E_{p}} = \frac{N_{s}}{N_{p}}\)
- \(E_{s} \times I_{s} = E_{p} \times I_{p}\)
🔹 সার-সংক্ষেপ
📌 তড়িৎ প্রবাহের চৌম্বক প্রভাব:
- তড়িৎ প্রবাহিত হলে পরিবাহীর চারপাশে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়।
- ওয়েরস্টেড প্রথম এই প্রভাব আবিষ্কার করেন।
- চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক নির্ধারণ করা যায়: ডানহাতি বৃদ্ধাঙ্গুলি নিয়ম ও ম্যাক্সওয়েলের কর্ক-স্ক্রু নিয়ম দ্বারা।
📌 সলিনয়েড:
- ঘন পাকযুক্ত অন্তরিত পরিবাহী, যার মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত হলে এটি দণ্ড চুম্বকের মতো আচরণ করে।
- তাড়িতচুম্বক তৈরি করতে লৌহদণ্ড প্রবেশ করানো হয়।
📌 তাড়িতচৌম্বক আবেশ:
- চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের ফলে কুণ্ডলীতে তড়িৎ আবিষ্ট হয়।
- ফ্যারাডে এই প্রক্রিয়ার দুটি সূত্র দেন।
- লেন্জের সূত্র: আবিষ্ট প্রবাহ কারণকে প্রতিহত করে।
📌 মোটর ও জেনারেটর:
- মোটর: তড়িৎ শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করে।
- জেনারেটর: যান্ত্রিক শক্তিকে তড়িৎ শক্তিতে রূপান্তর করে।
📌 ট্রান্সফরমার:
- AC প্রবাহে কাজ করে।
- বিভব বাড়াতে স্টেপ আপ, কমাতে স্টেপ ডাউন ট্রান্সফরমার ব্যবহার হয়।
📝 সৃজনশীল প্রশ্ন
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
চিত্রে একটি ট্রান্সফর্মারে মুখ্য ও ও গৌণ কুণ্ডলীর ভোল্টেজ যথাক্রমে \(E_p\) , এবং \(E_s\) , পাকসংখ্যা যথাক্রমে \(n_p\) এবং \(n_s\)। এখানে \(E_p =1000 V\) , \(E_s = 220 V\) , \(n_p = 880\).
ক. আর্মেচার কী?খ. তড়িৎ পরিবহনে ট্রান্সফর্মার ব্যবহার করা হয় কেন?গ. চিত্রে n এর মান বের কর।ঘ. গৌণ কুণ্ডলীতে 110 V পেতে হলে গৌণ কুণ্ডলীতে পাকসংখ্যার কী পরিবর্তন ঘটাতে হবে? উত্তরের সপক্ষে গাণিতিক ব্যাখ্যা দাও।
📝 সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর
ক. আর্মেচার কী?
একটি আর্মেচার হলো বৈদ্যুতিক মেশিনের (যেমন মোটর বা জেনারেটর) সেই অংশ যা দিয়ে পরিবর্তী তড়িৎ প্রবাহ (alternating current) প্রবাহিত হয়। সাধারণত, এটি সেই অংশ যেখানে চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা ভোল্টেজ আবিষ্ট হয়, অথবা যেখানে আর্মেচার থেকে আসা চৌম্বক ক্ষেত্র অন্য একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে ঘূর্ণন বল (torque) তৈরি করে। অনেক ডিসি মোটর এবং জেনারেটরে, আর্মেচার হলো ঘূর্ণনশীল কুণ্ডলী, যেখানে প্রধান চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে এমন তড়িৎ-চুম্বক বা স্থায়ী চুম্বকগুলি স্থির অংশে থাকে, যাকে স্টেটর বলা হয়।
খ. তড়িৎ পরিবহনে ট্রান্সফর্মার ব্যবহার করা হয় কেন?
ট্রান্সফর্মারগুলো কার্যকরী তড়িৎ পরিবহনের জন্য অপরিহার্য কারণ তারা ভোল্টেজকে বাড়াতে এবং কমাতে সাহায্য করে। দীর্ঘ দূরত্বে বিদ্যুৎ প্রেরণের জন্য, আমরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একটি স্টেপ-আপ ট্রান্সফর্মার ব্যবহার করে ভোল্টেজকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিই এবং এর ফলে তড়িৎ প্রবাহ (current) কমিয়ে দিই। যেহেতু ট্রান্সমিশন লাইনে প্রতিরোধের কারণে ক্ষমতার অপচয় (power loss) \(P_{loss} = I^{2}R\) সূত্র দ্বারা নির্ধারিত হয়, তাই তড়িৎ প্রবাহ (I) কমানোর মাধ্যমে শক্তির অপচয় ব্যাপকভাবে হ্রাস করা যায়। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর, একটি স্টেপ-ডাউন ট্রান্সফর্মারের সাহায্যে উচ্চ ভোল্টেজকে বাসা-বাড়ি এবং ব্যবসার জন্য নিরাপদ ও ব্যবহারযোগ্য স্তরে নামিয়ে আনা হয়।
\(n_{s}\)-এর মান নির্ণয় করুন।
আমরা ট্রান্সফর্মারের সমীকরণ ব্যবহার করে সেকেন্ডারি কুণ্ডলীর পাকসংখ্যা, \(n_{s},\) নির্ণয় করতে পারি, যা প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি কুণ্ডলীর ভোল্টেজ ও পাকসংখ্যার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে।
ট্রান্সফর্মারের সমীকরণটি হলো:
$$\frac{E_{p}}{E_{s}} = \frac{n_{p}}{n_{s}}$$
প্রদত্ত মানগুলো হলো:
প্রাইমারি ভোল্টেজ, \(E_{p} = 1000 V\)
সেকেন্ডারি ভোল্টেজ, \(E_{s} = 220 V\)
প্রাইমারি পাকসংখ্যা, \(n_{p} = 880\)
আমাদের \(n_{s}\)-এর মান বের করতে হবে। \(n_{s}\)-এর জন্য সমীকরণটি সাজিয়ে পাই:
$$ n_s = n_p \times \frac{E_s}{E_p}$$
$$n_{s}= 880 \times \frac{220}{1000}$$
$$n_{s} = 880 \times 0.22 n_{s}= 194$$
\(n_{s}\)-এর মান হলো 194। যেহেতু পাকসংখ্যা একটি পূর্ণসংখ্যা হওয়া উচিত, এই ফলাফলটি একটি আদর্শ বা তাত্ত্বিক পরিস্থিতি নির্দেশ করে।
ঘ. সেকেন্ডারি কুণ্ডলীতে 110 V পেতে হলে সেকেন্ডারি কুণ্ডলীতে পাকসংখ্যার কী পরিবর্তন ঘটাতে হবে?
সেকেন্ডারি কুণ্ডলীতে 110 V পেতে হলে, আমাদের সেকেন্ডারি কুণ্ডলীর জন্য প্রয়োজনীয় নতুন পাকসংখ্যা গণনা করতে হবে।
ধরা যাক এই নতুন পাকসংখ্যা হলো \(n_{s_{new}}\)।
একই ট্রান্সফর্মারের সমীকরণ ব্যবহার করে পাই:
\(\frac{E_{p}}{E_{s_{new}}} = \frac{n_{p}}{n_{s_{new}}}\)
প্রদত্ত মানগুলো হলো:
প্রাইমারি ভোল্টেজ, \(E_{p} = 1000 V\)
নতুন সেকেন্ডারি ভোল্টেজ, \(E_{s_{new}} = 110 V\)
প্রাইমারি পাকসংখ্যা, \(n_{p} = 880\)
\(n_{s_{new}}\)-এর জন্য সমাধান করে পাই:
$$ n_{s_{new}} = n_{p} \times \frac{E_{s_{new}}}{E_p}$$ $$n_{s_{new}} = 880 \times \frac{110}{1000}$$
$$n_{s_{new}} = 880 \times 0.11$$
$$n_{s_{new}}= 97$$
মূল সেকেন্ডারি পাকসংখ্যা ছিল 194। প্রয়োজনীয় নতুন পাকসংখ্যা হলো 97। সেকেন্ডারি কুণ্ডলীতে 110 V পেতে হলে, সেকেন্ডারি কুণ্ডলীর পাকসংখ্যা 194 থেকে 97-এ কমিয়ে আনতে হবে। এটি একটি হ্রাস।
গণিতের ব্যাখ্যা হলো, ট্রান্সফর্মারের সমীকরণ অনুযায়ী, ভোল্টেজের অনুপাত পাকসংখ্যার অনুপাতের সাথে সরাসরি সমানুপাতিক।
যখন আমরা আউটপুট ভোল্টেজ কমাতে চাই \((E_{s_{new}} < E_s),\)
তখন প্রাইমারি কুণ্ডলীর বৈশিষ্ট্য স্থির রেখে সেকেন্ডারি কুণ্ডলীর পাকসংখ্যাও কমাতে হবে \((n_{s_{new}} < n_s)\)।