চলবিদ্যুৎ: মৌলিক ধারণা, গাণিতিক ব্যাখ্যা ও ব্যবহারিক প্রেক্ষাপট

আমাদের এই পোস্টে চলবিদ্যুতের মৌলিক ধারণা, সূত্র, গাণিতিক ব্যাখ্যা এবং বোর্ডের পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। চলবিদ্যুতের সব জটিল বিষয় সহজে বোঝার জন্য এই লেখাটি খুবই সহায়ক হবে।

চল তড়িৎ

এই অধ্যায়ের প্রতিটি বিষয়ের সংজ্ঞা, সূত্র এবং গাণিতিক ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো।


তড়িৎ প্রবাহ (Current Electricity)

সংজ্ঞা:

প্রতি সেকেন্ডে কোনো পরিবাহীর যেকোনো প্রস্থচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যে পরিমাণ আধান প্রবাহিত হয়, তাকেই তড়িৎ প্রবাহ বলে।

সূত্র ও গাণিতিক ব্যাখ্যা:

যদি t সেকেন্ডে কোনো পরিবাহীর মধ্য দিয়ে Q পরিমাণ আধান প্রবাহিত হয়, তাহলে তড়িৎ প্রবাহ (I) হবে:

$$I = \frac{Q}{t}$$

তড়িৎ প্রবাহের একক হলো কুলম্ব/সেকেন্ড, যা অ্যাম্পিয়ার (A) নামে পরিচিত।

তড়িৎ প্রবাহের দিক:

তড়িৎ প্রবাহের প্রচলিত দিক ধরা হয় উচ্চতর বিভব থেকে নিম্নতর বিভবের দিকে। তবে, যেহেতু তড়িৎ ঋণাত্মক আধান বা ইলেকট্রনের প্রবাহের জন্য হয়, তাই এর প্রকৃত দিক হলো নিম্ন বিভব থেকে উচ্চ বিভবের দিকে। অর্থাৎ, প্রচলিত দিক ও প্রকৃত দিক পরস্পর বিপরীত।


পরিবাহী, অপরিবাহী ও অর্ধপরিবাহী

  • পরিবাহী (Conductor): যে সকল পদার্থের মধ্য দিয়ে আধান বা ইলেকট্রন সহজে প্রবাহিত হতে পারে, সেগুলোকে পরিবাহী বলে। যেমন: রূপা, তামা, লোহা ইত্যাদি। তাপ প্রয়োগ করলে পরিবাহীর তড়িৎ প্রবাহে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
  • অপরিবাহী (Insulator): যে সকল পদার্থের মধ্য দিয়ে আধান প্রবাহিত হতে পারে না, সেগুলোকে অপরিবাহী বলে। যেমন: কাচ, কাঠ, প্লাস্টিক ইত্যাদি। অপরিবাহী পদার্থ তড়িৎ প্রবাহে বাধা দান করে।
  • অর্ধপরিবাহী (Semiconductor): যে পদার্থের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ পরিবাহীর চেয়ে কম কিন্তু অপরিবাহীর চেয়ে বেশি, তাদের অর্ধপরিবাহী বলে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি করলে অর্ধপরিবাহীর রোধ হ্রাস পায় এবং এর তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। যেমন: জার্মেনিয়াম, সিলিকন।

তড়িৎ বর্তনী (Electric Circuit)

সংজ্ঞা:

তড়িৎ প্রবাহ চলার সম্পূর্ণ পথকে তড়িৎ বর্তনী বলে। যখন একটি কোষ বা ব্যাটারীর দুই প্রান্তে এক বা একাধিক রোধ বা তড়িৎ যন্ত্র যুক্ত করা হয়, তখন একটি বর্তনী তৈরি হয়।

বর্তনী সংযোগ:

বর্তনীতে উপকরণগুলোকে প্রধানত দুইভাবে যুক্ত করা যায়:

  • শ্রেণি সংযোগ (Series connection): যখন রোধ বা অন্যান্য উপকরণগুলো একটির পর একটি পর্যায়ক্রমে যুক্ত থাকে। এই সংযোগে সকল উপকরণের মধ্য দিয়ে সমান পরিমাণ তড়িৎ প্রবাহিত হয়।
  • সমান্তরাল সংযোগ (Parallel connection): যখন প্রতিটি উপকরণের এক প্রান্ত একটি সাধারণ বিন্দুতে এবং অপর প্রান্তগুলো অপর একটি সাধারণ বিন্দুতে যুক্ত থাকে। এই সংযোগে সকল উপকরণের দুই প্রান্তে বিভব পার্থক্য সমান থাকে।

রোধ (Resistance)

প্রতীক: \( R \)
সংজ্ঞা: তড়িৎ প্রবাহে বাধা প্রদানকারী ধর্ম
সূত্র: \( R = \frac{V}{I} \)
একক: ওহম (\( \Omega \))

আপেক্ষিক রোধ (Resistivity)

প্রতীক: \(\rho \)
সংজ্ঞা: পদার্থের নিজস্ব রোধ ধর্ম
সূত্র: \( R = \rho \frac{L}{A} \)
একক: ওহম-মিটার (\( \Omega \cdot m \))

সমতুল্য রোধ (Equivalent Resistance)

শ্রেণী সংযোগ:

$$ R{\text{eq}} = R1 + R2 + R3 + \ldots $$ সমান্তরাল সংযোগ:

$$ \frac{1}{R{\text{eq}}} = \frac{1}{R1} + \frac{1}{R_2} + \ldots $$


ও'মের সূত্র (Ohm's Law)

সংজ্ঞা:

স্থির তাপমাত্রায়, কোনো নির্দিষ্ট পরিবাহীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ প্রবাহ পরিবাহীর দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্যের সমানুপাতিক।

সূত্র ও গাণিতিক ব্যাখ্যা:

যদি কোনো পরিবাহীর দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্য V হয় এবং এর মধ্য দিয়ে I পরিমাণ তড়িৎ প্রবাহ হয়, তাহলে ও'মের সূত্রানুসারে:

$$ I \propto V$$

বা, \(V = IR\) 

এখানে,

  • V হলো বিভব পার্থক্য।
  • I হলো তড়িৎ প্রবাহ।
  • R হলো পরিবাহীর রোধ। রোধের একক ও'ম (\( \Omega \))।

এই সূত্র থেকে রোধের সূত্র হলো $$R = \frac{V}{I}$$

 কোনো পরিবাহীর দুই প্রান্তে বিভব পার্থক্য 1V হলে যদি এর মধ্য দিয়ে 1A তড়িৎ প্রবাহিত হয়, তবে পরিবাহীর রোধ \(1 \, \Omega \) হবে।


বিভব পার্থক্য (Potential Difference)

প্রতীক: \( V \)
সংজ্ঞা: একক আধানকে সরাতে প্রয়োজনীয় কাজ
সূত্র: \( V = \frac{W}{Q} \)
একক: ভোল্ট (V)


তড়িচ্চালক শক্তি (Electromotive Force)

সংজ্ঞা:

এক কুলম্ব আধানকে কোষ বা উৎসসহ একটি বর্তনীর এক বিন্দু থেকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে আবার ঐ বিন্দুতে আনতে যে পরিমাণ কাজ সম্পন্ন করতে হয়, তাকে ঐ কোষ বা উৎসের তড়িচ্চালক শক্তি (E) বলে। এর একক ভোল্ট (V)।

সূত্র ও গাণিতিক ব্যাখ্যা:

যদি কোনো কোষ বা উৎসকে Q পরিমাণ আধানকে নিম্ন বিভব প্রান্ত থেকে উচ্চ বিভব প্রান্তে আনতে W পরিমাণ কাজ করতে হয়, তাহলে:

$$E = \frac{W}{Q}$$

যেখানে কাজের একক জুল (J) এবং আধানের একক কুলম্ব (C), তাই তড়িচ্চালক শক্তির একক হলো \(JC^{-1}\) বা ভোল্ট (V)।


তড়িচ্চালক শক্তি ও বিভব পার্থক্যের সম্পর্ক:

একটি বর্তনীতে তড়িৎ প্রবাহ চলার সময়, কোষের তড়িচ্চালক শক্তি (E) দুটি অংশে বিভক্ত হয়:

  • বর্তনীতে থাকা রোধের দুই প্রান্তের বিভব পতন বা প্রাপ্ত বিভব (V=IR)।
  • কোষের অভ্যন্তরীণ রোধ (r) এর কারণে হওয়া বিভব পতন (Ir), যা হারানো বিভব বা সুপ্ত বিভব নামে পরিচিত।

এই সম্পর্কটি হলো:

$$E = V + Ir$$

যদি বর্তনী খোলা থাকে (তড়িৎ প্রবাহ না চলে), তাহলে I=0 হয়, এবং সে ক্ষেত্রে কোষের দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্যই তড়িচ্চালক শক্তির সমান হয় \((E=V)\)।


সৃজনশীল প্রশ্ন ও সমাধান

উদ্দীপক:
চিত্রটি লক্ষ করুন এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন

সৃজনশীল প্রশ্ন

ক. তড়িৎ প্রবাহ কাকে বলে?

খ. তড়িৎক্ষেত্রের সকল বিন্দুতে তীব্রতা সমান নয় কেন?

গ. উল্লিখিত বর্তনীর A ও B বিন্দুর বিভব পার্থক্য নির্ণয় কর।

ঘ. বর্তনীর ভোল্টেজ স্থির রেখে উল্লিখিত বোধগুলোকে সমান্তরালে যুক্ত করলে বর্তনীর প্রবাহমাত্রার কী পরিবর্তন হবে? গাণিতিক যুক্তিসহ বিশ্লেষণ কর।

সৃজনশীল প্রশ্নের সমাধান

ক. তড়িৎ প্রবাহ:

তড়িৎ প্রবাহ হলো কোনো পরিবাহীর মধ্য দিয়ে একক সময়ে যত পরিমাণ আধান প্রবাহিত হয়।

\( I = \frac{Q}{t} \)

এখানে, \( I \) = তড়িৎ প্রবাহ (Ampere), \( Q \) = আধান (Coulomb), \( t \) = সময় (second)

খ. তড়িৎক্ষেত্রর  সকল বিন্দুতে তীব্রতা সমান নয় কারণ:

  • রোধের কারণে তড়িৎ প্রবাহের পথে শক্তি ক্ষয় হয়
  • বিভব ধীরে ধীরে কমে যায়, বিশেষ করে রোধযুক্ত অংশে
  • ব্যাটারির ধনাত্মক ও ঋণাত্মক প্রান্তে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বিভব থাকে

গ. উদ্দীপকের বর্ণনা A ও B বিন্দুর বিভব পার্থক্য নির্ণয়:

ধরা যাক, A থেকে B পর্যন্ত রোধ \( R = 9\Omega \), এবং তড়িৎ প্রবাহ \( I = 10A \)

তাহলে, ওহমের সূত্র অনুযায়ী:

\( V_{AB} = IR = 10 \times 9 = 90V \)

অতএব, A ও B বিন্দুর বিভব পার্থক্য = 90V

ঘ.বর্তনীর ভোল্টেজ স্থির রেখে উল্লিখিত বোধগুলোকে সমান্তরালে যুক্ত করলে বর্তনীর প্রবাহমাত্রার পরিবর্তন:

সিরিজ সংযোগের ক্ষেত্রে

প্রদত্ত রোধসমূহ:

\( R_1 = 9\Omega, \quad R_2 = 6\Omega, \quad R_3 = 3\Omega \)

ভোল্টেজ: \( V = 180V \)

সিরিজ সংযোগে মোট রোধ:

\( R = R_1 + R_2 + R_3 = 9 + 6 + 3 = 18\Omega \)

ওহমের সূত্র অনুযায়ী:

\( I = \frac{V}{R} = \frac{180}{18} = 10A \)

⇒ বর্তনীতে প্রবাহমাত্রা: 10A

সমান্তরাল সংযোগের ক্ষেত্রে

প্রদত্ত রোধসমূহ:

\( R_1 = 9\Omega, \quad R_2 = 6\Omega, \quad R_3 = 3\Omega \)

ভোল্টেজ: \( V = 180V \)

সমান্তরাল সংযোগে মোট রোধ:

\( R_p = \frac{R_1 R_2 R_3}{R_1 R_2 + R_2 R_3 + R_3 R_1}\)

\(= \frac{9 \times 6 \times 3}{9 \times 6 + 6 \times 3 + 3 \times 9}\)

\(= \frac{162}{99}\)

\(= 1.64\Omega \)

ওহমের সূত্র অনুযায়ী:

\( I = \frac{V}{R_p} = \frac{180}{1.64} = 110 A \)

⇒ বর্তনীতে প্রবাহমাত্রা: 110A

সিরিজের তুলনায় প্রবাহমাত্রা বৃদ্ধি: \( 110A - 10A = 100A \)

নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :

রাহীদের বাসায় তিনটি বাতি আছে। বাতি তিনটির গায়ে 100 W-220 V, 60 W-200 V এবং 40 W-220 V লেখা আছে।

ক. তড়িৎ ক্ষমতা কী?

খ. একটি বাতির গায়ে 220 V-32 W লেখা আছে; এর অর্থ কী?

গ. তিনটি বাতি প্রতিদিন 6 ঘণ্টা করে জ্বালালে 31 দিনের এক মাসে কত ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হবে?

ঘ. দ্বিতীয় বাতিটির ফিলামেন্টের রোধ প্রথম বাতিটির ফিলামেন্টের রোধ অপেক্ষা বেশী, গাণিতিক যুক্তিসহ বিশ্লেষণ কর।

ক. তড়িৎ ক্ষমতা কী?

তড়িৎ ক্ষমতা বোঝায় কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্র প্রতি সেকেন্ডে কত জুল শক্তি ব্যবহার করে। এর সূত্র:

\( P = VI \)

যেখানে \( P \) = তড়িৎ ক্ষমতা (ওয়াট), \( V \) = বিভব পার্থক্য (ভোল্ট), \( I \) = তড়িৎ প্রবাহ (অ্যাম্পিয়ার)।

খ. একটি বাতির গায়ে 220 V - 32 W লেখা আছে; এর অর্থ কী?

এর মানে হলো:

  • বাতিটি 220 ভোল্টে চালানোর জন্য তৈরি।
  • এটি প্রতি সেকেন্ডে 32 জুল শক্তি ব্যবহার করে, অর্থাৎ 32 ওয়াট ক্ষমতা।

গ. তিনটি বাতি প্রতিদিন 6 ঘণ্টা করে জ্বালালে 31 দিনের এক মাসে কত ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হবে?

তিনটি বাতির মোট ক্ষমতা:

\( 100\,W + 60\,W + 40\,W = 200\,W \)

প্রতিদিন 6 ঘণ্টা:

\( 200\,W \times 6\,h = 1200\,Wh \)

31 দিনে:

\( 1200\,Wh \times 31\)

= 37200\,Wh = 37.2\,kWh \)

অতএব, মোট বিদ্যুৎ খরচ হবে 37.2 ইউনিট

ঘ. দ্বিতীয় বাতিটির ফিলামেন্টের রোধ প্রথম বাতিটির ফিলামেন্টের রোধ অপেক্ষা বেশী — বিশ্লেষণ:

রোধ নির্ণয়ের সূত্র:

\( R = \frac{V^2}{P} \)

প্রথম বাতি:

\( R_1 = \frac{220^2}{100} = \frac{48400}{100} = 484\,\Omega \)

দ্বিতীয় বাতি:

\( R_2 = \frac{200^2}{60} = \frac{40000}{60} \approx 666.67\,\Omega \)

অতএব, \( R_2 \gt; R_1 \), অর্থাৎ দ্বিতীয় বাতির রোধ বেশি।

চলবিদ্যুতের এই বিস্তারিত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি যে, এটি শুধু পদার্থবিজ্ঞানের একটি অধ্যায় নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওহমের সূত্রের সরলতা থেকে শুরু করে রোধের জটিল সমবায় এবং তড়িৎ ক্ষমতার গাণিতিক ব্যাখ্যা—সবকিছুই আমাদের চারপাশের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাগুলোকে বুঝতে সাহায্য করে। এই অধ্যায়ের মৌলিক ধারণাগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করে এবং সৃজনশীল প্রশ্নগুলোর সমাধান অনুশীলন করে তোমরা কেবল পরীক্ষায় ভালো ফল করবে না, বরং বাস্তব জীবনেও বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করবে। আশা করি, এই আলোচনা তোমাদের চলবিদ্যুৎ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ও গভীর ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে।

মন্তব্যসমূহ