পড়ন্ত বস্তুর গতি: সূত্র, ব্যাখ্যা এবং গ্যালিলিওর অবদান

বস্তুর পতন ও গ্যালিলিওর সূত্র: অভিকর্ষজ ত্বরণ এবং বিনা বাধায় পড়ন্ত বস্তুর গতির বিশ্লেষণ

পড়ন্ত বস্তুর সূত্রাবলি


ভূমিকা


মাটিতে পড়ন্ত বস্তুর গতিবিধি বিশ্লেষণ করার সময় আমরা বাতাসের বাধা এবং অভিকর্ষজ ত্বরণের ভূমিকা নিয়ে ভাবতে পারি। সাধারণত, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বস্তু যখন পড়ে, তখন এর ওপর বাতাসের বাধা ক্রিয়াশীল হয়। এই বাধা বিভিন্ন বস্তুর গতি পরিবর্তন করে। হালকা ও ভারী বস্তুর ক্ষেত্রে এই বাধার পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হয়। হালকা বস্তু, যেমন একটি কাগজের টুকরো, বাতাসের কারণে ধীর গতিতে নেমে আসে, যেখানে ভারী বস্তু, যেমন পাথর, অপেক্ষাকৃত দ্রুত মাটিতে পৌঁছে যায়। বাতাসের বাধাই এই পার্থক্যের কারণ।

তবে, গ্যালিলিও তাঁর পরীক্ষায় দেখিয়েছিলেন যে যদি বাতাসের বাধা না থাকে, তাহলে সকল বস্তু, তা হালকা হোক বা ভারী, একই হারে মাটিতে পড়বে। এটি অভিকর্ষজ ত্বরণের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য যে, এটি বস্তুর ভরের ওপর নির্ভর করে না। কোনো বস্তুর ভর যাই হোক না কেন, তা যদি মুক্তভাবে পড়ে, অর্থাৎ যদি শুধু অভিকর্ষ তার ওপর ক্রিয়াশীল থাকে এবং বাতাসের বাধা না থাকে, তাহলে সমস্ত বস্তু একই হারে ত্বরণ লাভ করবে এবং একই সময়ে মাটিতে পৌঁছাবে। উদাহরণস্বরূপ, কাগজের টুকরো এবং পাথর, উভয় বস্তুর ওপরই অভিকর্ষের প্রভাবে একই ত্বরণ কাজ করে। তাই যদি বাতাসের বাধা না থাকে, তাহলে কাগজ ও পাথর একই সময়ে মাটিতে পড়বে।

পড়ন্ত বস্তুর গতি বোঝার জন্য গ্যালিলিও তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন, যেগুলোকে আমরা পড়ন্ত বস্তুর সূত্র বলে থাকি। এই সূত্রগুলো কেবল তখনই প্রযোজ্য যখন কোনো বস্তু স্থির অবস্থা থেকে বিনা বাধায় পড়তে শুরু করে। অর্থাৎ, বস্তুর ওপর কেবলমাত্র অভিকর্ষ ক্রিয়াশীল থাকবে, এবং অন্য কোনো বাহ্যিক শক্তি, যেমন বাতাসের বাধা, তার গতি প্রভাবিত করবে না।

গ্যালিলিও দেখিয়েছেন যে যখন কোনো বস্তু পড়তে শুরু করে, তখন তার কোনো আদি বেগ থাকে না। বস্তুটি স্থির অবস্থা থেকে পতন শুরু করে এবং অভিকর্ষের প্রভাবে তার গতি ক্রমান্বয়ে বাড়ে। এই অবস্থায় বস্তুর ওপর কেবলমাত্র অভিকর্ষজ বল কাজ করে, যা বস্তুকে মাটির দিকে টেনে নিয়ে যায়। বাতাসের বাধা যদি না থাকে, তবে বস্তুর পতনের গতি সম্পূর্ণ অভিকর্ষের দ্বারা নির্ধারিত হবে এবং সেটি ক্রমাগত ত্বরণ লাভ করবে।

পড়ন্ত বস্তুর সূত্রগুলো মূলত বস্তুর প্রাথমিক বেগ, ত্বরণ, এবং পতনকালীন অবস্থান (অথবা দূরত্ব) বোঝার জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রথম সূত্র থেকে আমরা বস্তুর চূড়ান্ত বেগ নির্ণয় করতে পারি। দ্বিতীয় সূত্র বস্তুর পতনের দূরত্ব এবং তৃতীয় সূত্র বস্তুর বেগ ও অবস্থান সম্পর্কিত।

সুতরাং, গ্যালিলিওর এই আবিষ্কার আমাদের বলে যে মুক্তভাবে পতনশীল কোনো বস্তুর গতি এবং তার উপর ক্রিয়াশীল শক্তি বিশ্লেষণ করা সম্ভব, যদি আমরা বাতাসের বাধা বা অন্য কোনো বাহ্যিক প্রভাব উপেক্ষা করতে পারি।

পড়ন্ত বস্তুর সূত্রাবলির বিবৃতি:


প্রথম সূত্র: স্থির অবস্থা এবং একই উচ্চতা থেকে বিনা বাধায় পড়ন্ত সকল বস্তুই সমান সময়ে সমান পথ অতিক্রম করে।

দ্বিতীয় সূত্র: স্থির অবস্থান থেকে বিনা বাধায় পড়ন্ত বস্তুর নির্দিষ্ট সময় (t) তে প্রাপ্ত বেগ (v) ঐ সময়ের সমানুপাতিক অর্থে, \( v \propto t \)।

তৃতীয় সূত্র: স্থির অবস্থা থেকে বিনা বাধায় পড়ন্ত বস্তুর নির্দিষ্ট সময় (t) তে অতিক্রম করা দূরত্ব (h) ঐ সময়ের বর্গের সমানুপাতিক অর্থে, \( h \propto t^2 \)।

পড়ন্ত বস্তুর সূত্রাবলির ব্যাখ্যা:


প্রথম সূত্র: এ সূত্রানুসারে স্থির অবস্থান থেকে কোনো বস্তু ছেড়ে দিলে তা যদি বিনা বাধায় মাটিতে পড়ে তাহলে মাটিতে পড়ার যে সময় লাগবে তা বস্তুটির ভর, আকার বা আকারের উপর নির্ভর করে না। বিভিন্ন ভর, আকারের ও আয়তনের বস্তুগুলো যদি একই উচ্চতা থেকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং এগুলো যদি বিনাবাধায় মুক্তভাবে পড়ন্ত থাকে তাহলে সমপরিমাণ একই সময়ে মাটিতে পৌছায়।

দ্বিতীয় সূত্র: দ্বিতীয় সূত্র থেকে পাওয়া যায় যে সেকেন্ড শেষে বস্তুর বেগ \( v \propto t \) অর্থে, কোনো বস্তুর যদি স্থির অবস্থান থেকে বিনা বাধায় পড়তে দেয়া হয় তবে প্রথম সেকেন্ড পরে যদি \( v \) গতির একক হয় তাহলে দ্বিতীয় সেকেন্ডে এটি \( 2v \) বেগ অর্জন করবে। সূত্রানুযায়ী, \( t_1, t_2, t_3,... \) সেকেন্ড পরে যদি বস্তুর বেগ হয় \( v_1, v_2, v_3,... \) তাহলে ইন্টারভালে এ সূত্রানুযায়ী: \[ \frac{v_1}{t_1} = \frac{v_2}{t_2} = \frac{v_3}{t_3} = \dots =\] ধ্রুবক ।

তৃতীয় সূত্র: তৃতীয় সূত্র থেকে পাওয়া যায় যে সেকেন্ড শেষে বস্তুর অতিক্রম দূরত্ব \( h \propto t^2 \) অর্থে, কোনো বস্তুকে যদি স্থির অবস্থা থেকে বিনা বাধায় পড়তে দেয়া হয় তবে এক সেকেন্ডে এটি যে দূরত্ব অতিক্রম করবে তা দ্বিতীয় সেকেন্ডে \( 4h \) হবে, তৃতীয় সেকেন্ডে \( 9h \) দূরত্ব অতিক্রম করবে। সূত্রানুযায়ী, \( t_1, t_2, t_3,... \) ইন্টারভালে যদি বস্তুর অতিক্রান্ত দূরত্ব হয় \( h_1, h_2, h_3,... \) তাহলে সূত্রানুযায়ী: \[ \frac{h_1}{t_1^2} = \frac{h_2}{t_2^2} = \frac{h_3}{t_3^2} = \dots =\] ধ্রুবক ।

পড়ন্ত বস্তুর সূত্র এবং সমীকরণ প্রতিপাদন


পড়ন্ত বস্তুর গতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা নিউটনের গতির সূত্র ও ত্বরণের ধারণা ব্যবহার করি। যখন কোনো বস্তু ভূমি থেকে নীচের দিকে পড়ে তখন এটি অভিকর্ষজ ত্বরণের (g) কারণে এক প্রকার ত্বরণ লাভ করে। অভিকর্ষজ ত্বরণ পৃথিবীর দিকে ধাবিত হওয়া সমস্ত বস্তুকে প্রভাবিত করে, যার মান গড়পড়তা ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড²। নিচে পড়ন্ত বস্তুর গতি বোঝাতে ব্যবহৃত মূল তিনটি সূত্র এবং তাদের ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:

১. প্রথম সূত্র: \( v = u + gt \)


এই সূত্রটি বস্তুর গতিশক্তি ও সময়ের সম্পর্ক বর্ণনা করে।
\( v \) = বস্তুর চূড়ান্ত বেগ (m/s)
\( u \) = বস্তুর প্রাথমিক বেগ (m/s)
\( g \) = অভিকর্ষজ ত্বরণ (m/s²)
\( t \) = সময় (s)
প্রতিপাদন: আমরা জানি যে ত্বরণ, \( a = \frac{v - u}{t} \), যেখানে \( v \) চূড়ান্ত বেগ এবং \( u \) প্রাথমিক বেগ।
বস্তুটি যদি অভিকর্ষের প্রভাবে পড়ে, তবে \( a = g \), তাই \[ g = \frac{v - u}{t} \] \( v = u + gt \)
এটি দেখায় যে একটি বস্তু যদি স্থির অবস্থা থেকে পড়ে, তাহলে সময়ের সাথে তার বেগ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়।

২. দ্বিতীয় সূত্র: \( h = ut + \frac{1}{2}gt^2 \)


এই সূত্রটি পড়ে যাওয়া বস্তুর স্থানচ্যুতি নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।
\( h \) = স্থানচ্যুতি বা বস্তুর পতনের উচ্চতা (m)
\( u \) = প্রাথমিক বেগ (m/s)
\( g \) = অভিকর্ষজ ত্বরণ (m/s²)
\( t \) = সময় (s)
প্রতিপাদন: বস্তুটির স্থানচ্যুতি \( h \) বের করার জন্য প্রথমে বস্তুর গতি এবং সময়ের সম্পর্কটি ব্যবহার করা হয়। আমরা জানি \[ s = ut + \frac{1}{2}at^2 \] এখানে \( a = g \) এবং \( s = h \), সুতরাং \[ h = ut + \frac{1}{2}gt^2 \] যদি \( u = 0 \) হয়, অর্থাৎ বস্তুটি স্থির অবস্থা থেকে পড়ে, তাহলে \[ h = \frac{1}{2}gt^2 \]

৩. তৃতীয় সূত্র: \( v^2 = u^2 + 2gh \)


এই সূত্রটি চূড়ান্ত বেগ এবং স্থানচ্যুতির সম্পর্ক বর্ণনা করে।
\( v \) = চূড়ান্ত বেগ (m/s)
\( u \) = প্রাথমিক বেগ (m/s)
\( g \) = অভিকর্ষজ ত্বরণ (m/s²)
\( h \) = স্থানচ্যুতি (m)
প্রতিপাদন: প্রথম সূত্র অনুযায়ী \( v = u + gt \)। দ্বিতীয় সূত্র থেকে স্থানচ্যুতি \( h = ut + \frac{1}{2}gt^2 \)।
তৃতীয় সূত্র প্রাপ্তির জন্য আমরা সময় \( t \)-কে সরিয়ে ফেলব। \( t = \frac{v - u}{g} \) এই মানটি দ্বিতীয় সূত্রে প্রতিস্থাপন করলে \[ h = u\left(\frac{v - u}{g}\right) + \frac{1}{2}g\left(\frac{v - u}{g}\right)^2 \] সরলীকরণ করে, \[ v^2 = u^2 + 2gh \] এটি বস্তুর চূড়ান্ত বেগ এবং তার স্থানচ্যুতির মধ্যে সম্পর্ক দেখায়।

উপসংহার:


এই তিনটি সূত্রের মাধ্যমে পড়ন্ত বস্তুর গতি, স্থানচ্যুতি, এবং ত্বরণের সম্পর্ক খুব সহজে বোঝা যায়। এসব সূত্রের মাধ্যমে অভিকর্ষের প্রভাবে বস্তুর গতি বিশ্লেষণ করা সম্ভব, যা পদার্থবিজ্ঞানের গতি অধ্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

পদার্থবিজ্ঞানঃ ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য


পদার্থবিজ্ঞানঃ ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য unravel করার যাত্রা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সংযোগস্থল, যেখানে আপনি খুঁজে পাবেন আলো, শক্তি, এবং পদার্থের অপার দুনিয়া! জানান!"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন