ভূমিকা: বোরের পরমাণু মডেল ১৯১৩ সালে নীলস বোর প্রস্তাব করেন। এই মডেলটি হাইড্রোজেন পরমাণুর গঠন ও শক্তিস্তরের বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বোরের মডেলটি প্রাথমিকভাবে রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়, তবে এটি ইলেকট্রনের শক্তিস্তরের ধারণা প্রবর্তন করে।
বোরের মডেলের মূল স্বীকার্যসমূহ:
1. কৌণিক ভরবেগ সংক্রান্ত স্বীকার্য:
ইলেকট্রনের কৌণিক ভরবেগ নির্দিষ্ট মানে কোয়ান্টাইজড হয়। অর্থাৎ, ইলেকট্রন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে পারে যেখানে তার কৌণিক ভরবেগ \(L = n\hbar\) (n = 1, 2, 3, ...)।
2. শক্তি স্তর সংক্রান্ত স্বীকার্য:
ইলেকট্রন স্থায়ী কক্ষপথে ঘুরতে থাকে এবং এই কক্ষপথগুলির নির্দিষ্ট শক্তি স্তর থাকে। ইলেকট্রন কেবলমাত্র একটি শক্তি স্তর থেকে অন্য স্তরে যেতে পারে যখন এটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করে।
3. কম্পাঙ্ক সংক্রান্ত স্বীকার্য:
ইলেকট্রন যখন একটি উচ্চ শক্তি স্তর থেকে নিম্ন শক্তি স্তরে যায়, তখন এটি শক্তি বিকিরণ করে। এই বিকিরিত শক্তির কম্পাঙ্ক \(f\) হয় \( \Delta E = E_u - E_l = hf \) (\(h \) = প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক)।
হাইড্রোজেন পরমাণুর গঠন
হাইড্রোজেন পরমাণু হলো সবচেয়ে সহজ পরমাণু, যার মধ্যে মাত্র একটি প্রোটন এবং একটি ইলেকট্রন থাকে। এর কেন্দ্রস্থলে একটি প্রোটন থাকে, যা পরমাণুর নিউক্লিয়াস তৈরি করে। নিউক্লিয়াসের চারপাশে একটি ইলেকট্রন একটি কক্ষপথে ঘুরে। যেহেতু হাইড্রোজেনের মাত্র একটি ইলেকট্রন রয়েছে, এটি শক্তির স্তর অনুযায়ী বিভিন্ন অবস্থায় যেতে পারে।
নিউক্লিয়াস এবং ইলেকট্রন:
নিউক্লিয়াস: হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে একটি প্রোটন
থাকে। প্রোটন ধনাত্মক চার্জ বহন করে এবং এটি পরমাণুর অধিকাংশ ভর ধারণ করে।
ইলেকট্রন: পরমাণুর চারপাশে ঋণাত্মক চার্জযুক্ত একটি ইলেকট্রন
কক্ষপথে ঘোরে। ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে অবস্থান
করতে পারে।
শক্তিস্তরের বিশ্লেষণ ও শক্তিস্তরের বিভাজন
শক্তিস্তরের বিশ্লেষণ বলতে বোঝায় কোনো নির্দিষ্ট পরমাণু বা অণুর ইলেকট্রন শক্তিস্তরগুলির পরিবর্তন এবং তাদের অবস্থান নির্ধারণ করা। প্রতিটি ইলেকট্রন নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে থাকে এবং এই শক্তিস্তরগুলো কেবল নির্দিষ্ট শক্তি মান নিতে পারে। যখন ইলেকট্রন শক্তি শোষণ বা বিকিরণ করে, তখন তা অন্য শক্তিস্তরে স্থানান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট শক্তি পরিবর্তনের সাথে ঘটে, যা আমরা বিভিন্ন স্পেকট্রাম হিসেবে দেখতে পাই।
শক্তিস্তরের বিভাজন বলতে বোঝায়, পরমাণুর শক্তিস্তরগুলো বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হওয়া, যা বাইরের প্রভাবের কারণে ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, একটি চৌম্বক ক্ষেত্র বা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের প্রভাবে ইলেকট্রনের শক্তিস্তর বিভাজিত হতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি বিশেষভাবে দেখা যায় জ়িম্যান প্রভাব এবং স্টার্ক প্রভাবের ক্ষেত্রে।
শক্তিস্তরের বিভাজনের প্রধান উদাহরণ:
- জ়িম্যান প্রভাব: একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে শক্তিস্তরের বিভাজন।
- স্টার্ক প্রভাব: একটি বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের প্রভাবে শক্তিস্তরের বিভাজন।
বিভিন্ন শক্তিস্তরে শক্তির মান নির্ণয়ের সূত্র :
বোরের মডেল অনুযায়ী, হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন বিভিন্ন শক্তি স্তরে অবস্থান করতে পারে। প্রতিটি শক্তি স্তরের নির্দিষ্ট শক্তি মান থাকে যা \( E_n = - \frac{13.6 \text{eV}}{n^2} \) (n = 1, 2, 3, ...) দ্বারা নির্ধারিত হয়।
শক্তি শোষণ ও বিকিরণ প্রক্রিয়া
শক্তি শোষণ (Absorption)
শক্তি শোষণ একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি বস্তু (যেমন একটি পরমাণু বা অণু) বাইরে থেকে আসা শক্তিকে গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়ায়, ইলেকট্রন নিম্নতর শক্তিস্তর থেকে উচ্চতর শক্তিস্তরে উত্তীর্ণ হয়। শক্তি শোষণের ফলে ইলেকট্রনের শক্তিস্তর পরিবর্তিত হয় এবং তা উত্তেজিত অবস্থায় পৌঁছে।
উদাহরণ:
একটি হাইড্রোজেন পরমাণুতে, যখন আলোক কণা (ফোটন) নির্দিষ্ট শক্তির সমান হয়, তখন ইলেকট্রন এই ফোটনের শক্তি শোষণ করে এবং নিচের শক্তিস্তর থেকে উপরের শক্তিস্তরে চলে যায়। এই প্রক্রিয়ার ফলে আলোক কণাটি শোষিত হয় এবং ইলেকট্রনের শক্তিস্তর বাড়ে।
শক্তি বিকিরণ (Emission)
শক্তি বিকিরণ প্রক্রিয়ায়, উত্তেজিত ইলেকট্রন উচ্চতর শক্তিস্তর থেকে নিম্নতর শক্তিস্তরে ফিরে আসে এবং সেই সময়ে অতিরিক্ত শক্তি নির্গত করে। এই নির্গত শক্তি ফোটনের আকারে বের হয়, যা আলোর আকারে প্রদর্শিত হতে পারে।
উদাহরণ:
একটি উত্তেজিত হাইড্রোজেন পরমাণুতে, যখন ইলেকট্রন উচ্চতর শক্তিস্তর থেকে নিম্নতর শক্তিস্তরে ফিরে আসে, তখন তা অতিরিক্ত শক্তি নির্গত করে। এই শক্তিটি ফোটনের আকারে নির্গত হয়, যা আমরা আলো বা অন্য ধরনের বিকিরণ হিসেবে দেখতে পাই।
শক্তি শোষণ ও বিকিরণের ব্যাখ্যা:
শক্তি শোষণ ও বিকিরণ বস্তুর ইলেকট্রনগুলির শক্তিস্তর পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। শোষণের সময়, ইলেকট্রন শক্তি গ্রহণ করে এবং উত্তেজিত হয়। অন্যদিকে, বিকিরণের সময়, ইলেকট্রন তাদের স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে আসে এবং সেই শক্তি আলোর ফোটন আকারে মুক্ত হয়।
হাইড্রোজেনের বর্ণালির ব্যাখ্যা
হাইড্রোজেনের বর্ণালির ব্যাখ্যা করতে হলে প্রথমে এটমের গঠন এবং ইলেকট্রনের শক্তিস্তর নিয়ে আলোচনা করা দরকার। হাইড্রোজেন পরমাণুতে একটি প্রোটন এবং একটি ইলেকট্রন থাকে। ইলেকট্রন বিভিন্ন শক্তিস্তরে অবস্থান করতে পারে, যা কেবলমাত্র নির্দিষ্ট শক্তির মান নিতে পারে। যখন কোনো ইলেকট্রন একটি উচ্চতর শক্তিস্তর থেকে নিম্নতর শক্তিস্তরে যায়, তখন তা অতিরিক্ত শক্তি নির্গত করে, যা ফোটনের আকারে বের হয়।
এই ফোটনের শক্তি নির্ভর করে ইলেকট্রনের শক্তিস্তরের পার্থক্যের উপর। যেহেতু এই শক্তি নির্দিষ্ট মানের, তাই নির্গত ফোটনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যও নির্দিষ্ট হয়। এই নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলি একত্রে হাইড্রোজেন বর্ণালির সৃষ্টি করে। হাইড্রোজেন বর্ণালি ডিসক্রিট লাইনে বিভক্ত থাকে, যাকে আমরা "স্পেকট্রাল লাইন" বলি।
হাইড্রোজেন বর্ণালির প্রধান সিরিজগুলো:
- লায়মান সিরিজ: আল্ট্রাভায়োলেট অঞ্চলে পাওয়া যায়, যখন ইলেকট্রন n ≥ 2 থেকে n = 1 এ ফিরে আসে।
- বালমার সিরিজ: দৃশ্যমান অঞ্চলে পাওয়া যায়, যখন ইলেকট্রন n ≥ 3 থেকে n = 2 এ ফিরে আসে।
- পাশেন সিরিজ: ইনফ্রারেড অঞ্চলে পাওয়া যায়, যখন ইলেকট্রন n ≥ 4 থেকে n = 3 এ ফিরে আসে।
- ব্র্যাকেট এবং ফান্ড সিরিজ: আরও দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অঞ্চলে থাকে, যখন ইলেকট্রন n ≥ 5 থেকে n = 4, এবং n ≥ 6 থেকে n = 5 এ ফিরে আসে।
উপসংহার:
বোরের মডেল পরমাণু তত্ত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এটি ইলেকট্রনের শক্তিস্তরের ধারণা প্রবর্তন করে এবং হাইড্রোজেনের বর্ণালির ব্যাখ্যা প্রদান করে। তবে, এই মডেলটি শুধুমাত্র একক ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমাণুর জন্য কার্যকর এবং পরবর্তী গবেষণায় এর সীমাবদ্ধতা প্রকাশিত হয়। তবুও, বোরের মডেল পরমাণু তত্ত্বের উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
রাদারফোর্ড ও বোর পরমাণু মডেলের তুলনা
বিষয় | রাদারফোর্ড মডেল | বোর মডেল |
---|---|---|
মূল প্রস্তাবনা | পরমাণুর কেন্দ্রে ধনাত্মক চার্জযুক্ত একটি নিউক্লিয়াস থাকে এবং ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর চারপাশে ঘূর্ণায়মান থাকে। | ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণায়মান থাকে। |
ইলেকট্রনের গতি | ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে এলোমেলো পথে ঘোরে। | ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে যা শক্তি স্তর দ্বারা নির্ধারিত। |
শক্তি স্তর | কোনো শক্তি স্তরের ধারণা দেওয়া হয়নি। | ইলেকট্রন নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে থাকে এবং শক্তি শোষণ বা নির্গমন করার সময় স্তর পরিবর্তন করে। |
সীমাবদ্ধতা | পরমাণু স্থিতিশীলতা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। | নির্দিষ্ট শক্তিস্তরের ধারণা পরমাণুর স্থিতিশীলতা ব্যাখ্যা করতে সফল হয়েছে। |
মডেলের সফলতা | নিউক্লিয়াসের ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিল। | ইলেকট্রনের শক্তিস্তরের ধারণা এবং হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালী ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছিল। |