সরল দোলক (Simple Pendulum)
ভূমিকা: বর্তমান যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে বিভিন্ন প্রকারের দোলক নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে সরল দোলক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা যা বিভিন্ন প্রয়োগে ব্যবহৃত হয়। এই আর্টিকেলে আমরা সরল দোলকের সংজ্ঞা, কার্যপ্রণালী এবং এর প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করব।
সরল দোলক (Simple Pendulum) কী?
সরল দোলক হলো একটি বব (bob) যা একটি নমনীয় ও অপ্রসারনীয় সুতো বা রডের সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে ঝুলানো থাকে এবং এটি সাম্যাবস্থা থেকে সরিয়ে দিলে দোলন করে। সরল দোলক পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং এটি বিভিন্ন পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়।
সংজ্ঞা: একটি দৃঢ় অবলম্বন থেকে একটি ছোট, ভারী বস্তুকে যদি দীর্ঘ, ভরহীন ও অসম্পসারণশীল সুতোর মাধ্যমে ঝুলিয়ে মুক্তভাবে দোলানো যায়, তবে ঐ সুতাসহ ভারী বস্তুটিকে সরল দোলক বলা হয়।
সরল দোলকের গঠন
- 1. বব (Bob): এটি একটি ছোট, ভারী বস্তু যা দোলকের নিচের প্রান্তে থাকে।
- 2. সুতো বা রড (String or Rod): এটি একটি অদ্রাব্য সুতো বা রড যা ববকে ঝুলিয়ে রাখে। সুতো বা রডের দৈর্ঘ্য \( L \) দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
- 3. ঝুলন বিন্দু (Pivot Point): এটি সেই বিন্দু যেখানে সুতো বা রডটি স্থির থাকে এবং ববটি ঝুলানো থাকে।
সরল দোলকের কার্যপ্রণালী
সরল দোলকের কার্যপ্রণালী খুবই সহজ। যখন ভারী বস্তুটিকে তার সাম্যাবস্থার বাইরে সরানো হয়, তখন এটি মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে দোলতে থাকে। এই দোলন একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘটে, যা দোলকের দৈর্ঘ্য এবং মাধ্যাকর্ষণ ত্বরণের উপর নির্ভর করে। সরল দোলকের সময়কাল নির্ণয়ের জন্য গণিতের একটি নির্দিষ্ট সূত্র রয়েছে।
সরল দোলকের প্রয়োগ
সরল দোলকের বিভিন্ন প্রয়োগ রয়েছে। এটি ঘড়ির দোলক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা সময় পরিমাপের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষায় সরল দোলক ব্যবহার করা হয়। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা তাদের পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা বোঝাতে সহায়ক।
সরল দোলকের সাথে সংশ্লিষ্ট রাশি
- 1. দৈর্ঘ্য (L): সরল দোলকের দৈর্ঘ্য হলো ঝুলন বিন্দু থেকে ববের কেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্ব।
- 2. পর্যায়কাল (T): সরল দোলকের একটি পূর্ণ দোলন সম্পন্ন করতে যে সময় লাগে।
- 3. কম্পাঙ্ক (f): সরল দোলকের কম্পাঙ্ক হলো একক সময়ে সম্পন্ন দোলনের সংখ্যা।
- 4. বিস্তার (A): সরল দোলকের বিস্তার হলো সাম্যাবস্থা থেকে ববের সর্বাধিক সরণ।
- 5. কৌণিক কম্পাঙ্ক (ω): সরল দোলকের কৌণিক কম্পাঙ্ক হলো একক সময়ে অতিক্রান্ত কৌণিক দূরত্ব।
সরল দোলকের গতি সরল দোলন গতি
মনেকরি, \(m\) ভর ও \(L\) কার্যকরী দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট একটি সরল দোলক তার সাম্যাবস্থান থেকে \(\theta\) কোণে সরানো হয়েছে। এই অবস্থায়, ভারী বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল মাধ্যাকর্ষণ বল \(mg\) কে দুটি উপাংশে ভাগ করা যায়:
- একটি সুতার বরাবর \(mg \cos \theta\)
- অপরটি সুতার লম্বভাবে \(mg \sin \theta\)
সুতার টান \(T\) দ্বারা \(mg \cos \theta\) উপাংশটি নিষ্ক্রিয় হয়, ফলে কার্যকরী বল,
\(F = -mg \sin \theta\) হয়।
যেহেতু \(\theta\) খুব ছোট, তাই \(\sin \theta \approx \theta\) ধরা হয়। ফলে কার্যকরী বল: $$ F = -mg \theta $$
এই বলের জন্য ত্বরণ \(a\) হলে, নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী: $$ F = ma $$ অতএব, $$ ma = -mg \theta $$ বা, $$ a = -\frac{g}{L} x $$
এই সমীকরণটি সরল দোলকের গতি সরল দোলন গতি হিসেবে প্রমাণ করে।
সরল দোলন গতির সূত্র
সরল দোলকের গতি সরল দোলকের গতি সরল ছন্দিত গতি (Simple Harmonic Motion) হিসেবে বিবেচিত হয়। এর গতি সমীকরণ হলো:
$$ x(t) = A \sin(\omega t + \delta) $$
এখানে, \( x(t) \) হলো সময়ের সাথে সরণ,
\( A \) হলো বিস্তার,
\( \omega \) হলো কৌণিক কম্পাঙ্ক,
\( t \) হলো সময় এবং
\( \delta \) হলো দশা ধ্রুবক।
সরল দোলকের গতি সম্পর্কিত রাশিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক
পর্যায়কাল (T) এবং কম্পাঙ্ক (f): $$ T = \frac{1}{f} $$ $$ f = \frac{1}{T} $$
কৌণিক কম্পাঙ্ক (ω) এবং পর্যায়কাল (T): $$ \omega = \frac{2\pi}{T} $$ $$ T = \frac{2\pi}{\omega} $$
কৌণিক কম্পাঙ্ক (ω) এবং কম্পাঙ্ক (f): $$ \omega = 2\pi f $$ $$ f = \frac{\omega}{2\pi} $$
সরল দোলকের রাশিগুলোর গাণিতিক ব্যাখ্যা
- 1. দোলনকাল (Time Period): সরল দোলকের দোলনকাল \(T\) নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত সূত্রটি ব্যবহৃত হয়: $$ T = 2\pi \sqrt{\frac{L}{g}} $$ এখানে, \(L\) হলো দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য এবং \(g\) হলো মাধ্যাকর্ষণ ত্বরণ।
- 2. কৌণিক সরণ (Angular Displacement): সরল দোলকের কৌণিক সরণ \(\theta\) খুব ছোট হলে, \(\sin \theta \approx \theta\) ধরা হয়। এই অবস্থায়, সরল দোলকের গতি সরল দোলন গতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
- 3. ত্বরণ (Acceleration): সরল দোলকের ত্বরণ \(a\) নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত সমীকরণটি ব্যবহৃত হয়: $$ a = -\frac{g}{L} x $$ এখানে, \(x\) হলো সরণ এবং \(L\) হলো দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য।
- 4. কৌণিক গতি (Angular Velocity): সরল দোলকের কৌণিক গতি \(\omega\) নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত সমীকরণটি ব্যবহৃত হয়: $$ \omega = \sqrt{\frac{g}{L}} $$
এইভাবে, সরল দোলকের গাণিতিক ব্যাখ্যা এবং সূত্রাবলি আমাদের দোলকের গতি এবং সময়কাল সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়।
সরল দোলকের সূত্র ও পর্যায়কালের রাশিমালা নির্ণয়
বিজ্ঞানী গ্যালিলিও সরল দোলকের দোলনকালের চারটি সূত্র আবিষ্কার করেন, যা অল্প বিস্তারের জন্য প্রযোজ্য। কোনো সরল দোলকের দোলনকাল সম্পর্কিত চারটি সূত্র নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১ম সূত্র বা সমকাল সূত্র:কার্যকরী দৈর্ঘ্য এবং স্থান অপরিবর্তিত থাকলে \(4^{0}\) কৌণিক বিস্তারের মধ্যে সকল সরল দোলকের দোলনকাল ধ্রুব থাকে। অর্থাৎ, \(T \propto k\) [ যখন \(g\) এবং \(L\) অপরিবর্তনীয় এবং \( \theta \leq 4^{0}\)]
২য় সূত্র বা দৈর্ঘ্যের সূত্র: স্থান অপরিবর্তিত থাকলে \(4^{0}\) কৌণিক বিস্তারের মধ্যে সকল সরল দোলকের দোলনকাল তার কার্যকরী দৈর্ঘ্যের বর্গমূলের সমানুপাতিক। অর্থাৎ, \(T \propto \sqrt{L}\) [ যখন \(g\) অপরিবর্তনীয় এবং \( \theta \leq 4^{0}\)]
৩য় সূত্র বা ত্বরণের সূত্র:কার্যকরী দৈর্ঘ্য অপরিবর্তিত থাকলে \(4^{0}\) কৌণিক বিস্তারের মধ্যে সকল সরল দোলকের দোলনকাল ঐ স্থানের অভিকর্ষজ ত্বরণের বর্গমূলের ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ, \(T \propto \sqrt{\frac{1}{g}}\) [যখন \(L\) অপরিবর্তনীয় এবং \( \theta \leq 4^{0}\)]
৪র্থ সূত্র বা ভরের সূত্র: কার্যকরী দৈর্ঘ্য এবং স্থান অপরিবর্তিত থাকলে \(4^{0}\) কৌণিক বিস্তারের মধ্যে সকল সরল দোলকের দোলনকাল ববের ভর, আকৃতি, বা উপাদানের ঘনত্বের উপর নির্ভর করে না।
সরল দোলকের ২য় এবং ৩য় সূত্র থেকে পাই,
\(T \propto \sqrt{\frac{L}{g}}\) [যখন \(g\) অপরিবর্তনীয় এবং \( \theta \leq 4^{0}\)]
একত্রিত করলে,
\(T = k \sqrt{\frac{L}{g}}\) এখানে, \(k\) একটি সমানুপাতিক ধ্রুবক।
যে স্থানে \( g\) এর মান জানা, বিভিন্ন কার্যকরী দৈর্ঘ্য নিয়ে তার সাপেক্ষে \(T\) এর মান নির্ণয় করে উপরের সমীকরণে বসালে দেখা যায় এর মান \( 2 \pi \) এর সমান হয়।
অতএব, উপরের সমীকরণে এর মান বসালে আমরা পাই,
\(T = 2\pi \sqrt{\frac{L}{g}}\)
এটাই সরল দোলনকালের সমীকরণ। এই সমীকরণের সাহায্যে অভিকর্ষজ ত্বরণ g এর মান নির্ণয় করা যায়।
সেকেন্ড দোলক (Second Pendulum)
সেকেন্ড দোলক (Second Pendulum) হলো একটি বিশেষ ধরনের সরল দোলক যার দোলনকাল (period) দুই সেকেন্ড। অর্থাৎ, এটি এক সেকেন্ডে একবার অর্ধদোলন (half-oscillation) সম্পন্ন করে এবং পূর্ণ দোলন (full oscillation) সম্পন্ন করতে দুই সেকেন্ড সময় নেয়।
গাণিতিক উদাহরণ
একটি সেকেন্ড দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য কত?
এখন, একটি সেকেন্ড দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য (effective length) নির্ণয় করতে হলে আমাদের সরল দোলকের দোলনকাল সম্পর্কিত সূত্র ব্যবহার করতে হবে। সরল দোলকের দোলনকাল \( T \) এর সূত্রটি হলো:
$$ T = 2\pi \sqrt{\frac{L}{g}} $$
এখানে, \( T \) হলো দোলনকাল, \( L \) হলো দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য, \( g \) হলো অভিকর্ষজ ত্বরণ (acceleration due to gravity), যার মান প্রায় \( 9.8 \, \text{m/s}^2 \)।
সেকেন্ড দোলকের ক্ষেত্রে, \( T = 2 \) সেকেন্ড। এখন, এই মানগুলো সূত্রে বসিয়ে \( L \) এর মান নির্ণয় করা যাক: $$ 2 = 2\pi \sqrt{\frac{L}{9.8}} $$
প্রথমে, উভয় পাশে 2 দ্বারা ভাগ করি: $$ 1 = \pi \sqrt{\frac{L}{9.8}} $$
এখন, উভয় পাশে \( \pi \) দ্বারা ভাগ করি: $$ \frac{1}{\pi} = \sqrt{\frac{L}{9.8}} $$
এখন, উভয় পাশে বর্গ করি: $$ \left(\frac{1}{\pi}\right)^2 = \frac{L}{9.8} $$ অর্থাৎ, $$ \frac{1}{\pi^2} = \frac{L}{9.8} $$
এখন, \( L \) এর মান নির্ণয় করতে \( 9.8 \) দ্বারা গুণ করি: $$ L = \frac{9.8}{\pi^2} $$ \( \pi \) এর মান প্রায় 3.14159, তাই:
$$ L = \frac{9.8}{(3.14159)^2} \approx \frac{9.8}{9.8696} \approx 0.994 \, \text{m} $$
অতএব, একটি সেকেন্ড দোলকের কার্যকরী দৈর্ঘ্য প্রায় 0.994 মিটার বা 99.4 সেন্টিমিটার।
উপসংহার
সরল দোলক পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা যা বিভিন্ন পরীক্ষায় এবং সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর বিভিন্ন রাশি এবং গতি সম্পর্কিত সমীকরণগুলো পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।