স্থিতিস্থাপকতা: পদার্থের স্থিতিস্থাপক বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগ

স্থিতিস্থাপকতা: পদার্থের স্থিতিস্থাপক বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগ

স্থিতিস্থাপকতা (ELASTICITY)

বিষয়বস্তু

  • পদার্থের গঠন
  • আন্তঃআণবিক বলের প্রকৃতি
  • স্থিতিস্থাপকতা
  • স্থিতিস্থাপকতা সম্পর্কে কয়েকটি রাশি
  • কঠিন বস্তুর স্থিতিস্থাপক ব্যবহার
  • পীড়ন
  • বিকৃতি
  • হুকের সূত্র
  • স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের প্রকারভেদ
  • পয়সন-এর অনুপাত
  • বিকৃতির দরুন কৃত কাজ যা সঞ্চিত বা বিভব শক্তি
  • ইস্পাত রবার অপেক্ষা অধিক স্থিতিস্থাপক
  • স্থিতিস্থাপকতা কোন কোন শর্তের উপর নির্ভর করে

ভূমিকা:

স্থিতিস্থাপকতা পদার্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌত ধর্ম। এটি এমন একটি ধর্ম যা বল প্রয়োগের ফলে বিকৃত হওয়া পদার্থকে বল সরিয়ে নেয়ার পর আদি অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম করে। এই ধর্মের কারণে আমরা বিভিন্ন উপাদানকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে পারি। স্থিতিস্থাপক পদার্থগুলি বাহ্যিক বলের প্রভাবে বিকৃত হলেও তাদের মূল আকারে ফিরে আসার ক্ষমতা রাখে। দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং প্রকৌশল খাতে স্থিতিস্থাপকতার গুরুত্ব অপরিসীম। এই বিষয়টি পদার্থের গঠন, আণবিক বলের প্রকৃতি, এবং বিকৃতির সময় শক্তি সঞ্চয়ের উপর নির্ভর করে।

পদার্থের গঠন:

পদার্থের গঠন মূলত অণু ও পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত। এই অণু ও পরমাণুর মধ্যে আন্তঃআণবিক বল ক্রিয়া করে, যা পদার্থের স্থিতিস্থাপকতার জন্য দায়ী।

আন্তঃআণবিক বলের প্রকৃতি:

আন্তঃআণবিক বল হল সেই বল যা অণু ও পরমাণুর মধ্যে ক্রিয়া করে। এই বলের কারণে পদার্থের স্থিতিস্থাপকতা নির্ধারিত হয়। আন্তঃআণবিক বলের প্রকারভেদ যেমন ভ্যান ডার ওয়ালস বল, কভ্যালেন্ট বল, এবং আয়নিক বল ইত্যাদি পদার্থের স্থিতিস্থাপকতার উপর প্রভাব ফেলে।

স্থিতিস্থাপকতা:

স্থিতিস্থাপকতা হল সেই ধর্ম যা বল প্রয়োগের ফলে বিকৃত হওয়া পদার্থকে আদি অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম করে। বিজ্ঞানী রবার্ট হুক ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কার করেন যে, অধিকাংশ স্থিতিস্থাপক বস্তুর সামান্য বিকৃতি ঘটানো হলে তা রৈখিক স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করে। এই নীতিকে হুকের সূত্র বলা হয়।

স্থিতিস্থাপকতা সম্পর্কে কয়েকটি রাশি:

  • স্থিতিস্থাপক সীমা (Elastic Limit): সর্বোচ্চ যে পরিমাণ বল প্রয়োগ করলে বস্তু আদি অবস্থায় ফিরে যেতে পারে।
  • পীড়ন (Stress): বাহ্যিক বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর অভ্যন্তরে উদ্ভূত প্রতিরোধ বল।
  • বিকৃতি (Strain): বাহ্যিক বল প্রয়োগের ফলে বস্তুর আকার বা আয়তনের পরিবর্তন।

কঠিন বস্তুর স্থিতিস্থাপক ব্যবহার:

কঠিন বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী যেমন ইস্পাত, কংক্রিট ইত্যাদি স্থিতিস্থাপকতার উপর ভিত্তি করে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যেমন স্প্রিং, রবার ব্যান্ড ইত্যাদি স্থিতিস্থাপকতার উপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়।

স্থিতিস্থাপকতার সাথে কয়েকটি রাশি বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট। নিম্নে তাদের আলোচনা করা হলঃ

(ক) পূর্ণ স্থিতিস্থাপক বস্তু (Perfectly elastic body): কোন বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করার পর সেই বল অপসারণ করলে যদি বস্তুটি সম্পূর্ণভাবে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে, তবে তাকে পূর্ণ স্থিতিস্থাপক বস্তু বলা হয়। বাস্তবে, কোন বস্তুই পূর্ণ স্থিতিস্থাপক নয়।

(খ) নমনীয় বস্তু (Plastic body): বল প্রয়োগে বস্তুর বিকৃতি ঘটে, অর্থাৎ বস্তু বিকৃত হয়। বিকৃতিকারী বল অপসারণের পর যদি বস্তুর পূর্বাবস্থা ফিরে না আসে, তবে তাকে নমনীয় বস্তু বলা হয় এবং বস্তুর এই ধর্মকে নমনীয়তা বলা হয়। এই বস্তুকে অস্থিতিস্থাপক বস্তুও বলা হয়।

(গ) পূর্ণ দৃঢ় বস্তু (Perfectly rigid body): কোন বস্তুর উপর যে কোন পরিমাণ বল প্রয়োগ করেও যদি তার বিকৃতি বা কায়িক পরিবর্তন ঘটানো না যায়, তবে তাকে পূর্ণ দৃঢ় বস্তু বলা হয়। প্রকৃতিতে কোন বস্তুই পূর্ণ দৃঢ় নয়, কারণ বল প্রয়োগে কিছু না কিছু বিকৃতি ঘটে। তবে কাচ, ইস্পাত প্রভৃতি বস্তুকে সাধারণত পূর্ণ দৃঢ় বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

(ঘ) স্থিতিস্থাপক সীমা (Elastic limit): বল প্রয়োগে প্রত্যেক বস্তুরই অল্পবিস্তর বিকৃতি ঘটে। বল অপসারণ করলে স্থিতিস্থাপকতার দরুন বস্তু পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। প্রযুক্ত বলের পরিমাণ বেশি হলে বিকৃতিও বেশি হয়। প্রত্যেক বস্তুরই বলের একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পূর্ণ স্থিতিস্থাপক থাকে। প্রযুক্ত বাহ্যিক বলের যে সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত কোন বস্তু পূর্ণ স্থিতিস্থাপক থাকে, তাকে ঐ বস্তুর স্থিতিস্থাপক সীমা বলা হয়। বিভিন্ন বস্তুর স্থিতিস্থাপক সীমা বিভিন্ন। ইস্পাত ও হীরার স্থিতিস্থাপক সীমা খুব বেশি, আবার দস্তার স্থিতিস্থাপক সীমা খুব কম।

(ঙ) অসহ ভার এবং অসহ পীড়ন (Breaking weight and breaking stress): স্থিতিস্থাপক সীমা পর্যন্ত কোন বস্তু পূর্ণ স্থিতিস্থাপক থাকে। প্রযুক্ত বল ঐ সীমা অতিক্রম করলে বস্তু পূর্ণ স্থিতিস্থাপক থাকে না। বল অপসারিত হলে কিছু বিকৃতি থেকে যায়। যদি প্রযুক্ত বলের মান ক্রমশ বৃদ্ধি করা যায়, তবে বস্তুটির এমন এক অবস্থা আসে যখন ভার সহ্য করতে না পেরে ভেঙ্গে বা ছিঁড়ে যায়। ন্যূনতম যে নির্দিষ্ট ভারের ক্রিয়ায় কোন বস্তু ভেঙ্গে বা ছিঁড়ে যায়, তাকে অসহ ভার বা অসহ ওজন বলা হয়। একে ভঞ্জক-ভারও বলা হয়। কোন বস্তুর একক ক্ষেত্রফলের উপর প্রযুক্ত অসহ ভারকে অসহ পীড়ন বলা হয়।

(চ) স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি (Elastic fatigue): পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, কোন বস্তু বা তারের উপর ক্রমাগত পীড়নের হ্রাস-বৃদ্ধি করলে পীড়নের সাথে সাথে বিকৃতি হয় না; বিকৃতি ধীর গতিতে সংঘটিত হয় এবং বস্তুর স্থিতিস্থাপক ধর্মের অবনতি ঘটে। এই অবস্থায় বস্তু যেন খানিকটা ক্লান্তিতে ভোগে। এমতাবস্থায় অসহ ভার অপেক্ষা কম ভারে তারটি ছিঁড়ে যেতে পারে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী কেলভিন পদার্থের এই ধর্মকে স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি আখ্যা দিয়েছেন।

(ছ) বিকৃতি (Strain): আমরা জানি, কোনো বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করলে তার দৈহিক বা কায়িক পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনকে বিজ্ঞানের ভাষায় বিকৃতি বলা হয়। এই বিকৃতি দৈর্ঘ্যে, আকারে বা আয়তনে হতে পারে। কোনো বস্তুর একক মাত্রায় যে পরিবর্তন ঘটে, তা দ্বারা বিকৃতি পরিমাপ করা যায়।

ধরা যাক, কোনো বস্তুর আদি মাত্রা = x,
বল প্রয়োগের পর মাত্রা = y,
মাত্রার পরিবর্তন = \(x \sim y,\)
একক মাত্রায় পরিবর্তন অর্থাৎ বিকৃতি = \( \frac{x \sim y}{x}\)

বিকৃতির প্রকারভেদ: বিকৃতি মূলত তিন প্রকার, যথা-
(ক) দৈর্ঘ্য বিকৃতি বা অনুদৈর্ঘ্য বিকৃতি (Longitudinal strain),
(খ) আকার বিকৃতি বা কৃস্তন বিকৃতি (Shearing strain), এবং
(গ) আয়তন বিকৃতি (Volume strain)।

(ক) দৈর্ঘ্য বিকৃতি বা অনুদৈর্ঘ্য বিকৃতি (Longitudinal Strain)

সংজ্ঞা: দৈর্ঘ্য বিকৃতি হল একটি বস্তুর প্রাথমিক দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের অনুপাত। এটি সাধারণত একটি বাহ্যিক বলের প্রভাবে ঘটে।

গাণিতিক ব্যাখ্যা ও সূত্র:
দৈর্ঘ্য বিকৃতি, \(\epsilon_l\), সংজ্ঞায়িত করা হয়:
$$\epsilon_l = \frac{\Delta L}{L}$$
এখানে,
\(\Delta L\) = দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন,
\(L\) = প্রাথমিক দৈর্ঘ্য।

(খ) আকার বিকৃতি বা কৃন্তন বিকৃতি (Shearing Strain)

সংজ্ঞা: আকার বিকৃতি হল একটি বস্তুর আকারের পরিবর্তনের পরিমাপ, যেখানে বস্তুর আকার পরিবর্তিত হয় কিন্তু আয়তন অপরিবর্তিত থাকে।

গাণিতিক ব্যাখ্যা ও সূত্র:
কৃন্তন বিকৃতি, \(\gamma\), সংজ্ঞায়িত করা হয়:
$$\gamma = \tan(\theta)$$
এখানে,
\(\theta\) = বিকৃতির কোণ।

(গ) আয়তন বিকৃতি (Volume Strain)

সংজ্ঞা: আয়তন বিকৃতি হল একটি বস্তুর প্রাথমিক আয়তনের পরিবর্তনের অনুপাত।

গাণিতিক ব্যাখ্যা ও সূত্র:
আয়তন বিকৃতি, \(\epsilon_v\), সংজ্ঞায়িত করা হয়:
$$\epsilon_v = \frac{\Delta V}{V}$$
এখানে,
\(\Delta V\) = আয়তনের পরিবর্তন,
\(V\) = প্রাথমিক আয়তন।

এই তিনটি বিকৃতির ধারণা পদার্থবিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে পদার্থের স্থিতিস্থাপকতা এবং বলবিদ্যার ক্ষেত্রে।

পীড়নের প্রকারভেদ

পীড়ন হল বাহ্যিক বলের প্রভাবে কোনো বস্তুর মধ্যে উদ্ভূত প্রতিরোধী বল। এটি বস্তুর আকার বা আয়তনে পরিবর্তন ঘটায়। পীড়নের প্রধান তিনটি প্রকারভেদ হল দৈর্ঘ্য পীড়ন, কৃন্তন বা মোচড় পীড়ন, এবং আয়তন পীড়ন।

১. দৈর্ঘ্য পীড়ন (Longitudinal Stress)

দৈর্ঘ্য পীড়ন তখন ঘটে যখন বাহ্যিক বল বস্তুর দৈর্ঘ্য বরাবর প্রয়োগ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি রডের দুই প্রান্তে টান দিলে রডের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। এই প্রকার পীড়নকে টান পীড়নও বলা হয়। দৈর্ঘ্য পীড়নের সূত্র হল:

$$\sigma = \frac{F}{A}$$

এখানে, \(\sigma\) হল দৈর্ঘ্য পীড়ন, \(F\) হল প্রয়োগকৃত বল, এবং \(A\) হল প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল।

২. কৃন্তন বা মোচড় পীড়ন (Shear Stress)

কৃন্তন পীড়ন তখন ঘটে যখন বাহ্যিক বল বস্তুর উপর স্পর্শক বরাবর প্রয়োগ করা হয়, যা বস্তুর আকার বিকৃতি ঘটায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি কাগজের টুকরোকে দুই বিপরীত দিকে টানলে এটি কৃন্তিত হয়। কৃন্তন পীড়নের সূত্র হল:

$$\tau = \frac{F}{A}$$

এখানে, \(\tau\) হল কৃন্তন পীড়ন, \(F\) হল প্রয়োগকৃত বল, এবং \(A\) হল প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল।

৩. আয়তন পীড়ন (Volume Stress)

আয়তন পীড়ন তখন ঘটে যখন বাহ্যিক বল বস্তুর উপর সব দিক থেকে প্রয়োগ করা হয়, যা বস্তুর আয়তন পরিবর্তন করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গ্যাসের কন্টেইনারে চাপ প্রয়োগ করলে গ্যাসের আয়তন কমে যায়। আয়তন পীড়নের সূত্র হল:

$$\sigma_v = \frac{F}{A}$$

এখানে, \(\sigma_v\) হল আয়তন পীড়ন, \(F\) হল প্রয়োগকৃত বল, এবং \(A\) হল প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল।

হুকের সূত্র (Hooke's Law)

হুকের সূত্র (Hooke's Law) পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক সূত্র যা স্থিতিস্থাপকতা (elasticity) সম্পর্কিত। এটি ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট হুক ১৬৭৬ সালে প্রস্তাব করেন। হুকের সূত্রের মূল বক্তব্য হলো, "স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে বস্তুর উপর প্রযুক্ত পীড়ন বিকৃতির সমানুপাতিক।"

হুকের সূত্রের বিবৃতি:

স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে, একটি বস্তুতে প্রযুক্ত বল (force) এবং তার বিকৃতি (deformation) পরস্পরের সমানুপাতিক। অর্থাৎ, যদি একটি বস্তুতে বল প্রয়োগ করা হয়, তাহলে সেই বস্তুর বিকৃতি সেই বলের সমানুপাতিক হবে।

গাণিতিক ব্যাখ্যা:

হুকের সূত্রকে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করা যায় নিম্নলিখিতভাবে:

$$ F = -kx $$

এখানে,

  • \( F \) হলো প্রযুক্ত বল (force),
  • \( x \) হলো বিকৃতি (deformation) বা স্থানচ্যুতি (displacement),
  • \( k \) হলো বস্তুটির স্থিতিস্থাপক ধ্রুবক (spring constant)।

এই সমীকরণে, \( k \) ধ্রুবকটি বস্তুটির স্থিতিস্থাপকতার পরিমাপক। এটি নির্ধারণ করে যে বস্তুটি কতটা শক্ত বা নরম।

উদাহরণ:

ধরা যাক, একটি স্প্রিংকে \( x \) দূরত্বে টানা বা সংকুচিত করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে, স্প্রিংটি তার স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে থাকলে, স্প্রিংটি \( k \) ধ্রুবক দ্বারা নির্ধারিত বল প্রয়োগ করবে। যদি \( k \) এর মান বেশি হয়, তাহলে স্প্রিংটি শক্ত হবে এবং কম হলে নরম হবে।

ব্যবহারিক প্রয়োগ:

হুকের সূত্র বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যেমন:

  • স্প্রিং এবং স্থিতিস্থাপক বস্তুগুলির বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে,
  • ইঞ্জিনিয়ারিং এবং স্থাপত্যে কাঠামোগত বিশ্লেষণে,
  • চিকিৎসা বিজ্ঞানে, যেমন অস্থি এবং টিস্যুর স্থিতিস্থাপকতা পরিমাপে।

এই সূত্রটি পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং বিভিন্ন বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হয়।

পয়সনের অনুপাত (Poisson's Ratio)

পয়সনের অনুপাত পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যা স্থিতিস্থাপকতা (elasticity) সম্পর্কিত। এটি ফরাসি বিজ্ঞানী সাইমন ডেনিস পয়সনের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে।

পয়সনের অনুপাতের বিবৃতি:

পয়সনের অনুপাত হলো, স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে, একটি বস্তুতে প্রযুক্ত বলের কারণে তার দৈর্ঘ্য পরিবর্তনের সাথে সাথে পার্শ্বীয় বিকৃতির অনুপাত।

গাণিতিক ব্যাখ্যা:

পয়সনের অনুপাতকে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করা যায় নিম্নলিখিতভাবে:

$$ \nu = -\frac{\epsilon_{\text{transverse}}}{\epsilon_{\text{axial}}} $$

এখানে,

  • \( \nu \) হলো পয়সনের অনুপাত,
  • \( \epsilon_{\text{transverse}} \) হলো পার্শ্বীয় বিকৃতি (transverse strain),
  • \( \epsilon_{\text{axial}} \) হলো দৈর্ঘ্য বিকৃতি (axial strain)।

উদাহরণ:

ধরা যাক, একটি রবারের চোঙকে টানা বা সংকুচিত করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে, চোঙটির দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেলে তার ব্যাস হ্রাস পাবে। যদি চোঙটির আদি দৈর্ঘ্য \( L \) এবং ব্যাস \( D \) হয়, এবং বল প্রয়োগের পর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়ে \( L + \Delta L \) এবং ব্যাস হ্রাস পেয়ে \( D - \Delta D \) হয়, তাহলে:

  • দৈর্ঘ্য বিকৃতি, \( \epsilon_{\text{axial}} = \frac{\Delta L}{L} \)
  • পার্শ্বীয় বিকৃতি, \( \epsilon_{\text{transverse}} = \frac{\Delta D}{D} \)

সুতরাং, পয়সনের অনুপাত:

$$ \nu = -\frac{\Delta D / D}{\Delta L / L} $$

ব্যবহারিক প্রয়োগ:

পয়সনের অনুপাত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যেমন:

  • ইঞ্জিনিয়ারিং এবং স্থাপত্যে কাঠামোগত বিশ্লেষণে,
  • বিভিন্ন উপাদানের স্থিতিস্থাপক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে,
  • চিকিৎসা বিজ্ঞানে, যেমন অস্থি এবং টিস্যুর স্থিতিস্থাপকতা পরিমাপে।

এই সূত্রটি পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং বিভিন্ন বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হয়।

বিকৃতির দরুন কৃত কাজ বা সঞ্চিত বা বিভব শক্তি

বল প্রয়োগ করে যখন কোন বস্তুতে বিকৃতি করা হয়, তখন বস্তুতে উপর যে কাজ সম্পন্ন করা হয়, তা স্থিতিস্থাপকত্বের বস্তুতে সঞ্চিত থাকে। বস্তুতে বিভক্ত বিকৃতি সৃষ্টিতে যে কাজ সম্পন্ন হয় তা নিচে আলোচনা করা হল।

(ক) দৈর্ঘ্য বিকৃতি:

ধরি \(L\) দৈর্ঘ্য এবং \(A\) প্রস্থচ্ছেদবিশিষ্ট একটি তারে দৈর্ঘ্য বরাবর \(F\) বল প্রয়োগ করায় দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। ধরি যেই দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি হয়েছে তাকে \(dl\) বলে নির্দেশ করা হল। অতএব, ক্ষুদ্র দূরত্ব দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির কাজের পরিমাণ,

\(dW = \text{Force} \times \text{Displacement} = F \times dl \)

সুতরাং,

\(W = \int F \, dl \)

কিছু আমরা জানি,

\(Y\) = (দৈর্ঘ্য পীড়ন)/(দৈর্ঘ্য বিকৃতি)
বা, \(Y= \frac{\frac{F}{A}}{\frac{l}{L}} \)

অতএব,

\(F = \frac{Y \cdot A \cdot l}{L} \)

উপরের সমীকরণে \(F\)-এর মান বসিয়ে পাই,

\(W = \int \frac{Y \cdot A}{L} \, dl = \frac{Y \cdot A}{L} \int l \, dl = \frac{YA l^2}{2L} \)

এই ফাইবার ভলিউমের মধ্যে স্থিতিস্থাপক বিভব শক্তি হিসেবে সঞ্চিত থাকে।

যেখানে,

\(V\) = দৈর্ঘ্য \(\times\) প্রস্থচ্ছেদ
বা, \(V = AL \)

এবং একক আয়তনে কৃত কাজ বা একক আয়তনে সঞ্চিত শক্তি:

\(\frac{W}{V} = \frac{\frac{YA l^2}{2L}}{AL} = \frac{Y l^2}{2L^2} \)
= \(\frac{1}{2} \times\) দৈর্ঘ্য চাপ \(\times\) দৈর্ঘ্য বিকৃতি

ইস্পাত রবার অপেক্ষা অধিক স্থিতিস্থাপক

আমরা জানি, স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক = পীড়ন/বিকৃতি

উপরের সমীকরণ থেকে বলা যায় যে, যেসব বস্তুর ক্ষেত্রে পীড়ন এবং বিকৃতির অনুপাত বেশি, অর্থাৎ স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের মান বেশি, সেসব বস্তু বেশি স্থিতিস্থাপক। আর যেসব বস্তুর ক্ষেত্রে পীড়ন এবং বিকৃতির অনুপাত কম, অর্থাৎ স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের মান কম, সেসব বস্তু কম স্থিতিস্থাপক।

ইস্পাতের ক্ষেত্রে অধিক পীড়ন দেওয়া সত্ত্বেও বিকৃতির মান যৎসামান্য হয়। সুতরাং পীড়ন এবং বিকৃতির অনুপাত অনেক বেশি। কিন্তু রবারের ক্ষেত্রে অল্প পীড়ন দিলেই বিকৃতির মান অনেক বেশি হয়। সুতরাং রবারের ক্ষেত্রে পীড়ন এবং বিকৃতির অনুপাত অনেক কম। অতএব, সিদ্ধান্ত এই যে, ইস্পাত রবার অপেক্ষা অধিক স্থিতিস্থাপক।

স্থিতিস্থাপকতা কোন কোন শর্তের উপর নির্ভর করে ?

স্থিতিস্থাপকতা বিভিন্ন শর্তের উপর নির্ভর করে। আসুন, আমরা এই শর্তগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানি:

১. উপাদানের প্রকার

বিভিন্ন উপাদানের স্থিতিস্থাপকতা ভিন্ন হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইস্পাতের স্থিতিস্থাপকতা রাবারের চেয়ে অনেক বেশি। ইস্পাতের মতো কঠিন পদার্থের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক (Young's Modulus) বেশি থাকে, যা তাদেরকে অধিক বল প্রয়োগের পরও আদি অবস্থায় ফিরে আসতে সাহায্য করে

২. তাপমাত্রা

তাপমাত্রা স্থিতিস্থাপকতার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। সাধারণত, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে অধিকাংশ পদার্থের স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অণুগুলোর মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায় এবং তারা সহজেই বিকৃত হয়।

৩. বলের প্রয়োগের পরিমাণ ও ধরন

স্থিতিস্থাপকতা নির্ভর করে প্রয়োগকৃত বলের পরিমাণ ও ধরনের উপর। হুকের সূত্র অনুযায়ী, স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে প্রয়োগকৃত বল এবং বিকৃতির পরিমাণ সমানুপাতিক হয়। তবে, স্থিতিস্থাপক সীমা অতিক্রম করলে বস্তু স্থায়ীভাবে বিকৃত হয়ে যেতে পারে।

৪. সময়

স্থিতিস্থাপকতার উপর সময়ের প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সময় ধরে বল প্রয়োগ করা হলে বা বারবার বল প্রয়োগ ও অপসারণ করা হলে, বস্তু স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি (Elastic Fatigue) প্রদর্শন করতে পারে। এর ফলে বস্তুটি আদি অবস্থায় ফিরে আসতে দেরি করে বা পুরোপুরি ফিরে আসতে পারে না।

৫. আকার ও আকৃতি

বস্তুর আকার ও আকৃতিও স্থিতিস্থাপকতার উপর প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, পাতলা ও দীর্ঘ বস্তু সহজেই বিকৃত হয়, কিন্তু মোটা ও ছোট বস্তু তুলনামূলকভাবে কম বিকৃত হয়।

এই শর্তগুলো স্থিতিস্থাপকতার উপর প্রভাব ফেলে এবং বিভিন্ন উপাদানের স্থিতিস্থাপকতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

উপসংহার:

স্থিতিস্থাপকতা পদার্থবিজ্ঞানের এমন একটি অধ্যায় যেখানে পদার্থের প্রাকৃতিক এবং যান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা হয়। এটি কেবলমাত্র পদার্থের গুণমান ও শক্তির উপর নির্ভরশীল নয়, বরং প্রয়োগ এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইস্পাত, রবার ইত্যাদি উপাদানের স্থিতিস্থাপকতা আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নতির ক্ষেত্রে অতুলনীয় ভূমিকা রাখে। সার্লি পদ্ধতি এবং ইয়ং-এর স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের মাধ্যমে আমরা এই গুণাবলির সঠিক পরিমাপ ও প্রয়োগ নির্ধারণ করতে পারি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন