শব্দের বেগ (Velocity of Sound)
আজকের আর্টিকেলের বিষয়বস্তু
- শব্দের বেগ
- শব্দের বেগ সম্পর্কিত নিউটনের সূত্র
- বায়ু বা গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বেগ সম্পর্কীয় নিউটনের সূত্র প্রতিপাদন
- ল্যাপ্লাস কর্তৃক নিউটনের সূত্র সংশোধন
ভূমিকাঃ শব্দ তরঙ্গের আকারে মাধ্যমের মধ্য দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাত্রা করে। শব্দ এক সেকেন্ডে যে দূরত্ব অতিক্রম করে, সেটাই শব্দের বেগ। স্বাভাবিক চাপ ও তাপমাত্রায় শব্দের বেগ প্রায় \(332 \, ms^{-1}\)। এই বেগ আলোর বেগের তুলনায় অনেক কম। তাই আকাশে মেঘের ঘর্ষণে বজ্রপাত এবং বিদ্যুৎ চমক একই সময়ে সৃষ্টি হলেও, বজ্রপাতের শব্দ বিদ্যুৎ ঝলকানি দেখার কিছুক্ষণ পরে আমাদের কানে পৌঁছায়। আলোর বেগ শব্দের বেগের চেয়ে অনেক বেশি বলেই এমনটা ঘটে।
শব্দের বেগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে, যা দু'ভাগে ভাগ করা হয়েছে: (১) তত্ত্বীয় পদ্ধতি এবং (২) পরীক্ষাগার পদ্ধতি। বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটন তত্ত্বীয় পদ্ধতি প্রদান করেন, যা শব্দের বেগের জন্য নিউটনের সূত্র নামে পরিচিত। তিনটি পরীক্ষাগার পদ্ধতি রয়েছে, যার মধ্যে আমরা অনুনাদ বায়ুস্তম্ভ পদ্ধতি আলোচনা করব।
শব্দের বেগ সম্পর্কিত নিউটনের সূত্র (Newton's Law for the Velocity of Sound)
আমরা জানি, শব্দ সঞ্চালনের জন্য স্থিতিস্থাপক ও অবিচ্ছিন্ন (continuous) মাধ্যমের প্রয়োজন। তরঙ্গ প্রবাহে মাধ্যমের কণাগুলো পর্যায়গতিতে দুলতে থাকে এবং যে কোনো কণার বিচলন পরবর্তী মুহূর্তে পার্শ্ববর্তী কণায় সঞ্চালিত হয়। কোনো মাধ্যমে এ তরঙ্গ গতির বেগ বা দ্রুতি মাধ্যমের ঘনত্ব ও স্থিতিস্থাপকতার উপর নির্ভর করে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন গাণিতিকভাবে দেখান যে, শব্দের বেগ মাধ্যমের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের বর্গমূলের সমানুপাতিক এবং ঘনত্বের বর্গমূলের ব্যস্তানুপাতিক।
তিনি প্রমাণ করেন যে, \(E \) স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক এবং \(\rho\) ঘনত্ববিশিষ্ট কোন মাধ্যমে লম্বিক তরঙ্গের সৃষ্টি হলে ঐ তরঙ্গের বেগ,
$$ v = \sqrt\frac{E}{\rho} \quad \quad \quad (1) $$
লম্বিক শব্দ তরঙ্গ প্রবাহে কঠিন পদার্থের অস্থায়ী দৈর্ঘ্য পরিবর্তন হয়। এজন্য কঠিন পদার্থের ক্ষেত্রে স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক \(E\) কে ইয়ং-এর গুণাঙ্ক \(Y\) দ্বারা নির্দেশ করা হয়। সুতরাং কঠিন পদার্থে লম্বিক শব্দ তরঙ্গের বেগ,
$$ v = \sqrt\frac{Y}{\rho} \quad \quad \quad (2) $$
লোহার ইয়ং-এর গুণাঙ্ক, \(Y = 2.205 \times 10^{11} \, \text{Nm}^{-2} \) এবং ঘনত্ব, \( \rho = 7.85 \times 10^{3} \, \text{kgm}^{-3} \)।
কাজেই লোহার ভিতর শব্দের বেগ,
$$ v = \sqrt{\frac{2.205 \times 10^{11}}{7.85 \times 10^{3}}} \, \text{ms}^{-1} $$
বা, \( v = 5300 \, \text{ms}^{-1} \)
তরল অথবা গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দ তরঙ্গ প্রবাহের দরুন মাধ্যমের অস্থায়ী আয়তনের পরিবর্তন ঘটে এবং মাধ্যমের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক \(E\) কে আয়তনের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক \(K\) দ্বারা নির্দেশ করা হয়। সুতরাং তরল অথবা গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বেগ,
$$ v = \sqrt\frac{K}{\rho} \quad \quad \quad (3) $$
পানির আয়তনের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক \(K = 2.23 \times 10^{9} \, \text{Nm}^{-2} \) এবং ঘনত্ব \( \rho = 1 \times 10^{3} \, \text{kgm}^{-3} \)।
পানির মধ্যে শব্দের বেগ
$$ v = \sqrt{\frac{K}{\rho}} $$
বা, $$ v= \sqrt{\frac{2.23 \times 10 ^ {9}}{10 ^ {3}}} $$
বা, $$ v= 1493 \, ms^ {- 1} $$
বায়ু বা গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বেগ সম্পর্কীয় নিউটনের সূত্র প্রতিপাদন
নিউটনের সূত্রের সৃজনশীল রূপান্তর
নিউটন যখন বায়ু বা গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বেগ নিরূপণের চেষ্টা করছিলেন, তিনি ধারণা করেছিলেন যে গ্যাসের মধ্য দিয়ে তরঙ্গের সঞ্চালনকালে মাধ্যমের প্রসারণ ও সঙ্কোচন খুব ধীরে ধীরে ঘটে। ফলে তাপমাত্রার কোন পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ, শব্দ তরঙ্গ সঞ্চালনের সময় মাধ্যমের চাপ ও আয়তনের পরিবর্তন সমোষ্ণ অবস্থায় ঘটে। সুতরাং, এই ক্ষেত্রে বয়েলের সূত্র প্রযোজ্য।
ধরা যাক, সমোষ্ণ প্রক্রিয়ার জন্য কোন নির্দিষ্ট ভরের গ্যাসের চাপ \(P\) এবং আয়তন \(V\) হলে, বয়েলের সূত্রানুযায়ী,
\(PV\) = ধ্রুবক
\(V\)-এর সাপেক্ষে ব্যবকলন করে আমরা পাই,
$$ \frac{d}{dV} \left(PV\right) = 0 $$
বা, $$ P + V \frac{dP}{dV}=0 $$
বা, $$ P = - V \frac{dP}{dV}$$
বা, $$ P = - \frac{dP}{\frac{dV}{V}}$$
(এখানে ঋণাত্মক চিহ্ন দ্বারা চাপ বৃদ্ধি পেলে আয়তন হ্রাস অথবা চাপ হ্রাস পেলে আয়তন বৃদ্ধি বুঝায়)।
এখানে, \(\frac{dP}{\frac{dV}{V}} = K\) হচ্ছে গ্যাসের আয়তন গুণাঙ্ক।
অর্থাৎ, আয়তনের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক, \(K=P\)= প্রকৃত চাপ।
$$ v = \sqrt{\frac{K}{\rho}} $$
বা, $$ v = \sqrt{\frac{P}{\rho}} $$ তরঙ্গ সঞ্চালনকালে মাধ্যমের প্রসারণের জন্য অনুরূপভাবে প্রকাশ করা যায়,
$$ K = P $$
অর্থাৎ, $$ v = \sqrt{\frac{K}{\rho}} $$
বা, $$ v = \sqrt{\frac{P}{\rho}} $$
সুতরাং, বায়ু বা গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বেগ, $$ v = \sqrt{\frac{P}{\rho}} --- --- --- (4)$$
বায়ু বা গ্যাসীয় মাধ্যমে এটিই শব্দের বেগের জন্য নিউটনের সূত্র। এই সূত্র হতে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এবং চাপে বায়ুতে শব্দের বেগ নির্ণয় করা যায়।
স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অর্থাৎ \(0^{0} \, C\) তাপমাত্রায় বায়ু চাপ, \(P_{0} = 0.76 \times (13.6 \times 10^{3}) \times 9.81 \, Nm^{-2}\) এবং বায়ুর ঘনত্ব \(\rho_{0} = 0.001293 \times 10^{3} \, kgm^{-3}\)। যদি স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এবং চাপে বায়ুতে শব্দের বেগ \( v_{0}\) হয়, তবে সমীকরণ (4) অনুসারে
$$ v_{0} = \sqrt{\frac{P_{0}}{\rho_{0}}}$$
বা, $$ v_{0} = \sqrt{\frac{0.76 \times (13.6 \times 10^{3}) \times 9.81 \, Nm^{-2}}{0.001293 \times 10^{3} \, kgm^{-3}}}$$
বা, $$ v_{0} = 280 \, ms^{-1}$$
কিন্তু এই মান পরীক্ষালব্ধ মান অপেক্ষা অনেক কম। স্বাভাবিক চাপ এবং তাপমাত্রায় বায়ুতে শব্দের বেগের পরীক্ষালব্ধ মান \(332 ms^{-1}\)। এই গরমিল হতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, নিউটনের ধারণায় কোথাও ত্রুটি রয়েছে।
ল্যাপ্লাস কর্তৃক নিউটনের সূত্র সংশোধন:
নিউটনের সূত্রানুসারে গ্যাসে শব্দের বেগের তাত্ত্বিক মান ও পরীক্ষালব্ধ মানের মধ্যে একটি বিরাট গরমিল পরিলক্ষিত হয়। বিজ্ঞানী নিউটন এর কোন ব্যাখ্যাও প্রদান করেননি। প্রায় 120 বছর পর 1817 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি গণিতবিদ ল্যাপ্লাস যথাযথ ব্যাখ্যাসহ গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বেগ সম্পর্কিত নিউটন-এর সূত্রের প্রয়োজনীয় সংশোধন প্রদান করেন। এ সংশোধন ল্যাপ্লাসের সংশোধন নামে পরিচিত।
নিউটনের মতে, গ্যাসীয় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে শব্দ সঞ্চালনের সময় মাধ্যম ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হয়, ফলে তাপমাত্রার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তাই গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বিস্তার সমোঝ তাপীয় (Isothermal) প্রক্রিয়ায় হয় এবং এটি বয়েলের সূত্র মেনে চলে। কিন্তু ল্যাপ্লাস বলেন, গ্যাসীয় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে শব্দ সঞ্চালনের সময় সংকোচন ও প্রসারণ এত দ্রুত ঘটে যে তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়। গ্যাসের তাপ পরিবহণ ও বিকিরণ ক্ষমতা কম হওয়ায়, সংকোচনের সময় সৃষ্ট তাপ মাধ্যমের ঐ অংশেই থাকে এবং প্রসারণের সময় তাপমাত্রা হ্রাস পায়। ফলে গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বিস্তার রুদ্ধতাপ (Adiabatic) প্রক্রিয়ায় হয়।
এই প্রক্রিয়ায় গ্যাসের চাপ \(P\) ও আয়তন \(V\)-এর মধ্যে সম্পর্ক হলো:
\(PV^{\gamma} = K\),
যেখানে \( \gamma = \frac{C_{P}}{C_{V} }\)।
এক পরমাণুবিশিষ্ট গ্যাসের ক্ষেত্রে \( \gamma = 1.66\) এবং দ্বি-পরমাণুবিশিষ্ট গ্যাসের ক্ষেত্রে \( \gamma = 1.41\)।
রুদ্ধতাপ প্রক্রিয়ায়,
\(PV^{\gamma} = \) ধ্রুবক।
এখন \(V\)-এর সাপেক্ষে অবকলন করে পাই,
$$ V^{\gamma} \frac{dP}{dV} + P \cdot \gamma \cdot V^{\gamma - 1} = 0 $$
\( V^{\gamma-1} \) দিয়ে ভাগ করে পাই,
$$ V^{\gamma} \frac{dP}{dV} + \gamma P = 0 $$
বা, $$ \frac{dP}{- \frac{dV}{V} }= \gamma \cdot P $$
কিন্তু আয়তনের স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক,
$$ K = \frac{dP}{- \frac{dV}{V} } $$
বা, $$ K = \gamma \cdot P $$
সুতরাং গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বেগ,
$$ v = \sqrt{\frac{K}{\rho}}$$
বা, $$ v = \sqrt{\frac{\gamma \cdot P}{\rho}}$$
বায়ুর ক্ষেত্রে \( \gamma = 1.41\)। স্বাভাবিক চাপ ও তাপমাত্রায় \(P = 0.76 \times 13.6 \times 10^{3} \times 9.81 \, Nm^{-2} \) ও \(\rho = 0.001293 \times 10^{3} \, kg m^{-3}\)।
$$ v = \sqrt{\frac{1.42 \times 0.76 \times 13.6 \times 10^{3} \times 9.81 \, Nm^{-2} }{0.001293 \times 10^{3} \, kg m^{-3}}}$$
বা, $$ v = 332.52 \, ms^{-1}$$
এটি শব্দের বেগের পরীক্ষালব্ধ মানের প্রায় সমান যা ল্যাপ্লাসের সংশোধনের সত্যতা প্রমাণ করে। শব্দের বেগের উপর চাপ, তাপমাত্রা, মাধ্যমের ঘনত্ব, আর্দ্রতা এবং বায়ুপ্রবাহের প্রভাব আছে কিনা তা জানা আবশ্যক। এখানে আমরা তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও চাপের প্রভাব আলোচনা করব।
উপসংহার
আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা শব্দের বেগ এবং এর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেছি। প্রথমে আমরা শব্দের বেগ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি এবং তারপর নিউটনের সূত্রের মাধ্যমে বায়ু বা গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বেগের বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছি।
পরে, নিউটনের সূত্র প্রতিপাদন করা হয়েছে যা বায়ু বা গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের গতি ব্যাখ্যা করে। তবে, এই সূত্রের সীমাবদ্ধতা ছিল, যা ল্যাপ্লাস কর্তৃক সংশোধিত হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা শব্দের বেগ সম্পর্কে আরও নির্ভুল ব্যাখ্যা পাই।
সুতরাং, উপরের আলোচনার মাধ্যমে শব্দের বেগ সংক্রান্ত এই বিষয়গুলো সুস্পষ্ট হলো এবং এতে পদার্থবিজ্ঞানের এই গুরুত্বপূর্ণ ধারণার সঠিক উপলব্ধি সম্ভব হলো।