এক্স-রে: বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ, উৎপাদন পদ্ধতি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার ও গামা রশ্মির সাথে পার্থক্য
ভূমিকা:
এক্স-রে বা রঞ্জন রশ্মি আধুনিক চিকিৎসা ও প্রযুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলির মধ্যে একটি, যা জীবন রক্ষায় এবং বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। পদার্থবিজ্ঞানের এই বিশেষ বিকিরণ, যা দৃশ্যমান আলো থেকে আলাদা, মানবদেহের অভ্যন্তরীণ গঠন দেখতে সাহায্য করে। তবে এক্স-রে শুধুমাত্র চিকিৎসা ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি শিল্প, নিরাপত্তা ও গবেষণা ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই নিবন্ধে আমরা জানবো এক্স-রে কী, এর প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য, উৎপাদন পদ্ধতি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার। এছাড়াও আমরা এক্স-রে ও গামা রশ্মির মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কেও আলোচনা করবো।
এক্স-রে কি?
এক্স-রশ্মি বা রঞ্জন রশ্মি হল এক প্রকার তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলোর চেয়ে অনেক কম, সাধারণত ০.১ থেকে ১০ ন্যানোমিটার পরিসরে থাকে। এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর ছবি তৈরি করতে সাহায্য করে, বিশেষ করে হাড়ের। এক্স-রে দ্রুত এবং ব্যথাহীন প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার নির্ণয়ে সহায়ক।
এক্স-রে এর প্রকারভেদ
এক্স-রে প্রধানত দুই প্রকারের হয়:
- কোমল এক্স-রে: কোমল এক্স-রে কম শক্তির হয় এবং এটি সাধারণত নরম টিস্যু যেমন পেশী এবং অঙ্গের ছবি তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।
- কঠিন এক্স-রে: কঠিন এক্স-রে উচ্চ শক্তির হয় এবং এটি হাড় এবং দাঁতের মতো ঘন টিস্যুর ছবি তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।
এক্স রশ্মির উৎপাদন পদ্ধতি: গ্যাস নল পদ্ধতি
এক্স-রে উৎপাদনের জন্য একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যা এক্স-রে টিউব নামে পরিচিত। গ্যাস নল পদ্ধতিতে, এক্স-রে টিউবের মধ্যে দুটি ইলেকট্রোড থাকে: ক্যাথোড এবং অ্যানোড। ক্যাথোড থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয় এবং অ্যানোডে আঘাত করে, যার ফলে এক্স-রে বিকিরণ উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়ায় উচ্চ ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয় যাতে ইলেকট্রনগুলি দ্রুতগতিতে অ্যানোডে আঘাত করতে পারে এবং এক্স-রে উৎপন্ন হয়।
এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত কার্যকর এবং এটি বিভিন্ন চিকিৎসা পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়। এক্স-রে টিউবের গঠন এবং কার্যপ্রণালী এক্স-রে উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এক্স-রশ্মি বা রঞ্জন রশ্মির বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম
এক্স-রশ্মি বা রঞ্জন রশ্মি এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধর্মাবলি হল:
- উচ্চ ভেদন ক্ষমতা: এক্স-রশ্মি পদার্থের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে পারে, যা চিকিৎসা ক্ষেত্রে হাড়ের ছবি তোলার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- অদৃশ্য: দৃশ্যমান আলোর চেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য হওয়ায় এক্স-রশ্মি চোখে দেখা যায় না।
- তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ: এক্স-রশ্মি তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ হওয়ায় তড়িৎক্ষেত্র বা চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা এর গতিপথের কোনো পরিবর্তন হয় না।
- উৎপাদন: সাধারণত উচ্চ গতিতে ত্বরিত ইলেকট্রন কোনো ধাতব পাতকে আঘাত করলে এক্স-রশ্মি উৎপন্ন হয়।
এক্স-রশ্মির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার
চিকিৎসা ক্ষেত্রে
- রেডিওগ্রাফি: হাড়ের ফ্র্যাকচার, দাঁতের সমস্যা এবং অন্যান্য শারীরিক অস্বাভাবিকতা নির্ণয়ে এক্স-রশ্মি ব্যবহৃত হয়।
- সিটি স্ক্যান: শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিস্তারিত ছবি তোলার জন্য এক্স-রশ্মি ব্যবহার করা হয়।
- রেডিয়েশন থেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় টিউমার ধ্বংস করতে উচ্চ শক্তির এক্স-রশ্মি ব্যবহৃত হয়।
গোয়েন্দা বিভাগের ক্ষেত্রে
- বিমানবন্দরের নিরাপত্তা: লাগেজ এবং অন্যান্য প্যাকেজ স্ক্যান করতে এক্স-রশ্মি ব্যবহার করা হয়।
- বিস্ফোরক শনাক্তকরণ: সন্দেহজনক বস্তুতে বিস্ফোরক বা অস্ত্র আছে কিনা তা নির্ণয়ে এক্স-রশ্মি ব্যবহৃত হয়।
শিল্প ক্ষেত্রে
- নন-ডেস্ট্রাকটিভ টেস্টিং (NDT): যন্ত্রাংশের অভ্যন্তরীণ ত্রুটি বা ফাটল নির্ণয়ে এক্স-রশ্মি ব্যবহার করা হয়।
- গুণমান নিয়ন্ত্রণ: উৎপাদিত পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করতে এক্স-রশ্মি স্ক্যানিং ব্যবহৃত হয়।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায়
- ক্রিস্টালোগ্রাহয: প্রোটিন এবং অন্যান্য জটিল অণুর গঠন নির্ণয়ে এক্স-রশ্মি ব্যবহৃত হয়।
- পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা: পদার্থের অভ্যন্তরীণ গঠন এবং বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণে এক্স-রশ্মি ব্যবহৃত হয়।
এক্স রশ্মি ও গামা রশ্মির পার্থক্য
এক্স-রশ্মি এবং গামা রশ্মি উভয়ই তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণ, তবে তাদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে:
উৎপত্তি
- এক্স-রশ্মি: সাধারণত উচ্চ গতিতে ত্বরিত ইলেকট্রন কোনো ধাতব পাতকে আঘাত করলে এক্স-রশ্মি উৎপন্ন হয়। এটি সাধারণত এক্স-রে টিউব বা সিঙ্ক্রোট্রন থেকে আসে।
- গামা রশ্মি: গামা রশ্মি পারমাণবিক বিকিরণ থেকে উৎপন্ন হয়, যেমন রেডিওঅ্যাকটিভ নিউক্লিয়াসের ক্ষয় বা পারমাণবিক বিক্রিয়া।
শক্তি স্তর
- এক্স-রশ্মি: এক্স-রশ্মির শক্তি সাধারণত ১০ কেভি থেকে কয়েক মেভি পর্যন্ত হয়।
- গামা রশ্মি: গামা রশ্মির শক্তি এক্স-রশ্মির চেয়ে বেশি, সাধারণত কয়েক মেভি থেকে শুরু হয়।
ব্যবহার
- এক্স-রশ্মি: চিকিৎসা ক্ষেত্রে রেডিওগ্রাফি, সিটি স্ক্যান, এবং শিল্প ক্ষেত্রে নন-ডেস্ট্রাকটিভ টেস্টিংয়ে ব্যবহৃত হয়।
- গামা রশ্মি: চিকিৎসা ক্ষেত্রে ক্যান্সার থেরাপি, খাদ্য সংরক্ষণ, এবং পারমাণবিক গবেষণায় ব্যবহৃত হয়।
ভেদন ক্ষমতা
- এক্স-রশ্মি: এক্স-রশ্মির ভেদন ক্ষমতা গামা রশ্মির চেয়ে কম।
- গামা রশ্মি: গামা রশ্মির ভেদন ক্ষমতা বেশি, তাই এটি আরও গভীরে প্রবেশ করতে পারে।
তরঙ্গদৈর্ঘ্য
- এক্স-রশ্মি: এক্স-রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য সাধারণত ০.০১ থেকে ১০ ন্যানোমিটার।
- গামা রশ্মি: গামা রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য এক্স-রশ্মির চেয়ে কম, সাধারণত ০.০১ ন্যানোমিটারের কম।
এই পার্থক্যগুলো এক্স-রশ্মি এবং গামা রশ্মির বিভিন্ন ব্যবহার এবং বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে।
এক্স-রে-এর একক
এক্স-রের একক রন্টজেন (Roentgen)। যে পরিমাণ এক্স-রে প্রতি কিলোগ্রাম বায়ুতে \(2.58 \times 10^{-4}\) কুলম্ব আধান উৎপন্ন করতে পারে তাকে এক রন্টজেন বলে।
গাণিতিক উদাহরণ
একটি \(100 \, \text{MeV}\) ফোটনের কম্পাংক এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্ণয় কর।
আমরা জানি,
\( E = hf \)
এখানে:
- শক্তি, \(E = 100 \, \text{MeV}\)
- \( = 100 \times 10^6 \, \text{eV}\) \(= 100 \times 10^6 \times 1.6 \times 10^{-19} \, \text{J} \)
- কম্পাংক, \(f = ?\)
- তরঙ্গদৈর্ঘ্য, \(\lambda = ?\)
- আলোর গতি, \(c = 3 \times 10^8 \, \text{ms}^{-1}\)
- প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক, \(h = 6.63 \times 10^{-34} \, \text{Js}\)
\( \therefore f = \frac{E}{h} = \frac{100 \times 10^6 \times 1.6 \times 10^{-19} \, \text{J}}{6.63 \times 10^{-34} \, \text{Js}} = 2.41 \times 10^{22} \, \text{Hz} \)
আবার,
\( c = f \lambda \)
\( \lambda = \frac{c}{f} = \frac{3 \times 10^8 \, \text{ms}^{-1}}{2.41 \times 10^{22} \, \text{Hz}} = 1.24 \times 10^{-14} \, \text{m} \)
উত্তর: $$ 2.41 \times 10^{22} \, \text{Hz}$$ এবং $$1.24 \times 10^{-14} \, \text{m}$$
উপসংহার:
এক্স-রে প্রযুক্তির ব্যবহার আধুনিক সমাজে চিকিৎসা ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এর সাহায্যে শুধুমাত্র রোগ নির্ণয়ই নয়, নিরাপত্তা, শিল্প ও গবেষণার ক্ষেত্রে অসংখ্য সমস্যার সমাধান সম্ভব হচ্ছে। তবে এক্স-রে ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি, কারণ অতিরিক্ত বিকিরণ মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। গামা রশ্মির সাথে এক্স-রের পার্থক্য বুঝে উভয়কে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হলে আমরা আরও উন্নত এবং সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ গড়তে সক্ষম হবো।