শব্দের প্রতিধ্বনি: ব্যবহারিক প্রয়োগ ও সৃজনশীল প্রশ্নের সমাধান
শব্দের প্রতিফলন (Reflection of sound)
কোনো তরঙ্গ একটি সুষম মাধ্যমের মধ্য দিয়ে চলার সময় যদি ভিন্ন একটি মাধ্যমে বাধা পায় তাহলে তরঙ্গটি পূর্বের মাধ্যমে ফিরে আসে। এ ঘটনাকে প্রতিফলন বলে। শব্দ একটি অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ, সুতরাং শব্দ তরঙ্গ যদি চলার পথে বাধাপ্রাপ্ত হয় তাহলে তাও পূর্বের মাধ্যমে ফিরে আসে- একে শব্দের প্রতিফলন বলে। শব্দ তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেশ বড় বলে শব্দ তরঙ্গ প্রতিফলনের জন্য প্রতিফলক তলও বেশ বড় হওয়া প্রয়োজন।
প্রতিধ্বনি (Echo)
শব্দের প্রতিফলনের বাস্তব উদাহরণ প্রতিধ্বনি। রাতে ফাঁকা মাঠের মধ্যে বা নদীর পাড়ে পাহাড় বা সারিবদ্ধ দালানের নিকটে দাঁড়িয়ে জোরে শব্দ করলে সেই শব্দ একটু পরে পুনরায় শোনা যায়। একে প্রতিধ্বনি বলে। কোনো উৎস থেকে সৃষ্ট শব্দ যদি দূরবর্তী কোনো মাধ্যমে বাধা পেয়ে উৎসের কাছে ফিরে আসে তখন মূল ধ্বনির যে পুনরাবৃত্তি হয় তাকে শব্দের প্রতিধ্বনি বলে।
প্রতিফলকে প্রতিফলিত হয়ে কোনো শব্দ উৎসের কাছে দাঁড়ানো শ্রোতার কাছে ফিরে এলেই যে সে প্রতিধ্বনি স্পষ্ট করে শোনা যাবে তেমন কোনো কথা নেই। প্রতিধ্বনি শুনতে হলে শ্রোতা এবং প্রতিফলকের মধ্যে একটা ন্যূনতম দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কোনো শব্দ শোনার পর প্রায় 0.1 সেকেন্ড পর্যন্ত এর রেশ আমাদের মস্তিষ্কে থাকে। এ সময়কে শব্দানুভূতির স্থায়িত্বকাল বলে। প্রতিধ্বনি শোনার জন্য মূলধ্বনি ও প্রতিধ্বনি শোনার মধ্যবর্তী সময়ের পার্থক্য অন্তত 0.1 সেকেন্ড হওয়া প্রয়োজন। এর কম হলে মূলধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনিকে আলাদা করা যাবে না। সুতরাং প্রতিধ্বনি শোনার জন্য উৎস ও প্রতিফলকের মধ্যবর্তী দূরত্ব এমন হতে হবে যেন প্রতিফলন শব্দ (0.1 সেকেন্ডের আগে ফিরে আসতে না পারে।
ধরা যাক
S অবস্থানে উৎস এবং R অবস্থানে প্রতিফলক রাখা আছে । S ও R এর মধ্যবর্তী দূরত্ব d। এখন S অবস্থান থেকে শব্দ উৎপন্ন করলে সে শব্দ R প্রতিফলকে বাধা পেয়ে আবার S অবস্থানে ফিরে আসবে।
অর্থাৎ, শব্দকে S থেকে উৎপন্ন হয়ে আবার S অবস্থানে ফিরে আসার জন্য 2d দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। এখন S অবস্থানে যদি আমরা প্রতিধ্বনি শুনতে চাই তাহলে 2d দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য শব্দকে অন্তত 0.1 সেকেন্ড সময় ব্যয় বা অতিবাহিত করতে হবে।
আমরা জানি,
    দ্রুতি = দূরত্ব/সময়
    বা, \(v = \frac{2d}{t} \)
  
এখানে শব্দের দ্রুতি v, তা হলে লেখা যায়,
\[ d = \frac{v \times t}{2} \]
বাতাসে শব্দের দ্রুতি 0°C তাপমাত্রায় 332 ms-1 হলে,
\[ d = \frac{332 \times 0.1}{2} \, \text{m} = 16.6 \, \text{m} \]
অর্থাৎ, প্রতিফলিতশব্দ বা প্রতিধ্বনি শোনার জন্য উৎস ও প্রতিফলকের মধ্যবর্তী ন্যূনতম দূরত্ব 16.6 মিটার হওয়া প্রয়োজন।
প্রতিধ্বনির ব্যবহারিক প্রয়োগ: কূপের গভীরতা নির্ণয়
প্রতিধ্বনির সাহায্যে খুব সহজে কূপের পানি পৃষ্ঠের গভীরতা নির্ণয় করা যায়। কূপের উপরের কোনো শব্দ উৎপন্ন করলে সেই শব্দ পানি পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এলে প্রতিধ্বনি শোনা যায়। এখন শব্দ উৎপন্ন করা ও সেই শব্দের প্রতিধ্বনি শোনার মধ্যবর্তী সময় থামা ঘড়ির সাহায্যে নির্ণয় করা হয়।
ধরা যাক, কূপের গভীরতা h; শব্দ উৎপন্ন করা ও প্রতিধ্বনি শোনার মধ্যবর্তী সময় t; শব্দের দ্রুতি v; এখন শব্দ উৎপন্ন হওয়ার পর পানি পৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়ে শ্রোতার কাছে ফিরে আসতে যেহেতু 2h দূরত্ব অতিক্রম করে, অতএব,
\[ 2h = v \times t \]\[\implies h = \frac{v \times t}{2} \]
কূপের গভীরতা 16.6 মিটারের কম হলে, প্রতিধ্বনিভিত্তিক এই পরীক্ষাটি করা সম্ভব হবে না। আবার সমুদ্রের লোনা পানিতে শব্দের দ্রুতি জানা থাকলে, এ উপায়ে সমুদ্রের গভীরতা মাপা যায়।
সৃজনশীল প্রশ্ন ও সমাধান
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও:
20°C তাপমাত্রায় 40 cm তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের একটি ধাতব তারের মধ্যদিয়ে শব্দ 5130m/s বেগে চলমান আছে। তারটি বায়ু মাধ্যমে অবস্হিত আছে।
ক. সুরযুক্ত শব্দ কাকে বলে?
খ. প্রতিধ্বনি শোনার জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বের প্রয়োজন হয় কেন?
গ. বায়ু মাধ্যমে শব্দের বেগ 332m/s হলে কম্পাঙ্ক নির্ণয় কর।
ঘ. উদ্দীপকের মাধ্যমটি যদি ধাতব তার হতো তবে দুই মাধ্যমে কি একই সময়ে শব্দ শুনতে পারবে?
ক. সুরযুক্ত শব্দ কাকে বলে?
সুরযুক্ত শব্দ সেই ধরনের শব্দকে বোঝায়, যা একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে নিয়মিত ও সুষমভাবে অনুরণিত হয়। এটি শুনতে মধুর ও শ্রুতিমধুর হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাদ্যযন্ত্রের সুর বা মানুষের গানের সুর।
খ. প্রতিধ্বনি শোনার জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বের প্রয়োজন হয় কেন?
প্রতিধ্বনি শোনার জন্য এমন একটি দূরত্বের প্রয়োজন হয় যেখানে প্রতিফলিত শব্দ মূল শব্দের পরে পর্যাপ্ত সময়ের ব্যবধানে শোনা যায়। এটি ঘটে কারণ:
- শব্দের গতি \(v\) এর ভিত্তিতে, প্রতিধ্বনি শোনার জন্য শব্দের প্রতিফলিত হতে এবং ফিরে আসতে কমপক্ষে \(0.1\) সেকেন্ড সময় লাগে।
- 
      \(0^{0} C\) তাপমাত্রায় বায়ুতে শব্দের বেগ, 
 \(v = 332 \, \text{m/s}\) ধরলে,
 দূরত্ব \(s = \frac{v \times t}{2} = \frac{332 \times 0.1}{2} = 16.6\, \text{m}\)।
সুতরাং, প্রতিধ্বনি শোনার জন্য উৎস ও প্রতিবন্ধকের মধ্যে কমপক্ষে \(16.6\, \text{m}\) দূরত্ব প্রয়োজন।
গ. দেওয়া আছে,
শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য, \(\lambda = 40 \, \text{cm} = 0.4 \, \text{m}\)
শব্দের কম্পাঙ্ক, \(f = ?\)
20° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শব্দের বেগ:
\[ v = 332 \, \text{m/s} + 20 \times 0.6 \, \text{m/s} \] \[ v = 332 \, \text{m/s} + 12 \, \text{m/s} \]\[v = 344 \, \text{m/s} \]আমরা জানি,
\[ v = f \lambda \] সুতরাং, \[ f = \frac{v}{\lambda} \] \[ f = \frac{344 \, \text{m/s}}{0.4 \, \text{m}} = 860 \, \text{Hz} \]নির্ণেয় শব্দের কম্পাঙ্ক: \(860 \, \text{Hz}\)
ঘ. উদ্দীপক অনুসারে,
বায়ুতে শব্দের বেগ, 
\(v_a = 344 \, \text{ms}^{-1}\) ['গ' থেকে]
ধাতব তারে শব্দের বেগ, 
\(v_i = 5130 \, \text{ms}^{-1}\)
    শব্দের অতিক্রান্ত দূরত্ব, 
\(d = 4000 \, \text{cm} = 40 \, \text{m}\)
  
বায়ু মাধ্যমে প্রতিধ্বনি শোনার সময় = \(t_a\)
ধাতব মাধ্যমে প্রতিধ্বনি শোনার সময় = \(t_i\)
বায়ু মাধ্যমের ক্ষেত্রে,
আমরা জানি,
\[ 2d = v_a \cdot t_a \] বা, \[ t_a = \frac{2d}{v_a} = \frac{2 \ 40}{344} = 0.233 \, \text{s} \]আবার,
ধাতব মাধ্যমের ক্ষেত্রে,
আমরা জানি,
\[ 2d = v_i \cdot t_i \] বা, \[ t_i = \frac{2d}{v_i} = \frac{2 \times 40}{5130} = 0.0156 \, \text{s} \]উপরিউক্ত গাণিতিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়,
\( t_{a} \gt t_{i}\)
অর্থাৎ বায়ু মাধ্যমে ধাতব মাধ্যমের চেয়ে সময় বেশি। সূতরাং দুটি মাধ্যমে শব্দ একই সময়ে শোনা যাবে না। ধাতব মাধ্যমে শব্দ আগে শোনা যাবে।
 
       
       
       চিত্রঃ কুপের গভীরতা
চিত্রঃ কুপের গভীরতা