বিষয়বস্তু
- শক্তির রূপান্তর
- সংরক্ষণশীলতার নীতি
- গতিশক্তির সমীকরণ
- বিভব শক্তির সমীকরণ
- সংশ্লিষ্ট সৃজনশীল প্রশ্নের সমাধান
শক্তি প্রকৃতির এক অপরিহার্য উপাদান, যা বিভিন্ন রূপে আমাদের চারপাশে বিদ্যমান। শক্তি সংরক্ষণশীলতার নীতি অনুসারে, শক্তি নষ্ট হয় না, কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হয়। এই নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা দৈনন্দিন জীবনে কার্য সম্পাদন করি।
শক্তির রূপান্তর
শক্তির রূপান্তর বলতে এক রূপ থেকে অন্য রূপে শক্তির পরিবর্তনকে বোঝায়। পদার্থবিজ্ঞানে, শক্তি এমন একটি পরিমাণ যা কাজ সম্পাদনের সক্ষমতা সরবরাহ করে, যেমন কোনো বস্তু উত্তোলন করা বা তাপ সরবরাহ করা। শক্তি কখনোই তৈরি বা ধ্বংস হয় না, এটি কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। এই প্রক্রিয়াটি শক্তির সংরক্ষণ আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
শক্তির বিভিন্ন রূপ
শক্তির বিভিন্ন রূপ রয়েছে, যেমন:
- যান্ত্রিক শক্তি: গতিশক্তি এবং স্থিতিশক্তি এর অন্তর্ভুক্ত।
- তাপ শক্তি: তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে সৃষ্ট শক্তি।
- বৈদ্যুতিক শক্তি: বৈদ্যুতিক বিভব এবং তড়িৎ প্রবাহের মাধ্যমে সৃষ্ট শক্তি।
- রাসায়নিক শক্তি: রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্ত শক্তি।
- নিউক্লিয় শক্তি: পারমাণবিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্ত শক্তি।
শক্তির রূপান্তরের উদাহরণ
শক্তির রূপান্তরের অনেক উদাহরণ রয়েছে:
- বৈদ্যুতিক শক্তি থেকে তাপ শক্তি: বৈদ্যুতিক হিটার ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক শক্তিকে তাপ শক্তিতে রূপান্তর করা হয়।
- রাসায়নিক শক্তি থেকে যান্ত্রিক শক্তি: গাড়ির ইঞ্জিনে জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে রাসায়নিক শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করা হয়।
- সূর্যের শক্তি থেকে বৈদ্যুতিক শক্তি: সৌর প্যানেলের মাধ্যমে সূর্যের আলোক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করা হয়।
শক্তির সংরক্ষণ নীতি
শক্তির সংরক্ষণ নীতি অনুযায়ী, শক্তি কখনোই তৈরি বা ধ্বংস হয় না, এটি কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি পতনশীল বস্তু তার স্থিতিশক্তিকে গতিশক্তিতে রূপান্তরিত করে। একইভাবে, একটি চলন্ত গাড়ি ব্রেক করার সময় তার গতিশক্তিকে তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত করে।
মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতি
ধরা যাক, একটি বস্তু m ভরের এবং তার উচ্চতা h। বস্তুটি ভূমির দিকে পড়তে শুরু করেছে। প্রাথমিক অবস্থায় বস্তুটি স্থির ছিল।
A বিন্দুতে
বিভব শক্তি: \(U = mgh\)
গতি শক্তি: \(K = 0\)
মোট শক্তি: \(E = U + K = mgh + 0 = mgh\)
B বিন্দুতে
বস্তুটি \(x\) দূরত্ব অতিক্রম করেছে, ফলে উচ্চতা হয় \((h - x)\)।
বিভব শক্তি: \(U = mg(h-x)\)
গতি শক্তি: \(K = \frac{1}{2} mv^2\),
যেখানে
\(v^2 = 2gx\) (গতি সূত্র অনুযায়ী)।
সুতরাং, গতি শক্তি: \(K = mgx\)
মোট শক্তি: \[ E = U + K\] \[ = mg(h-x) + mgx = mgh \]
C বিন্দুতে
ভূমিতে পৌঁছালে: \(h = 0\)
বিভব শক্তি: \(U = 0\)
গতি শক্তি: \(K = mgh\)
মোট শক্তি: \(E = U + K = 0 + mgh = mgh\)
সুতরাং:
মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর মোট শক্তি সবসময় অপরিবর্তিত থাকে:
\( E = U + K\)
\(= mgh\)
= ধ্রুবক।
গতিশক্তি ও গতিশক্তির সমীকরণ প্রতিপাদন
ভূমিকা:
গতিশক্তি (Kinetic Energy) হলো একটি বস্তুর চলমান অবস্থায় যে শক্তি থাকে। এটি বস্তুর ভর এবং বেগের উপর নির্ভর করে। গতিশক্তির সমীকরণ প্রতিপাদন পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বিভিন্ন পরীক্ষায় এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা হয়।
গতিশক্তি:
গতিশক্তি \(E_k\) কে সংজ্ঞায়িত করা হয় একটি বস্তুর ভর \(m\) এবং বেগ \(v\) এর মাধ্যমে। এর সমীকরণটি হলো:
$$E_k = \frac{1}{2}mv^2$$
গতিশক্তির সমীকরণ প্রতিপাদন:
১. বস্তুর বেগ ও ত্বরণ: মনে করি, একটি বস্তু \(u\) আদিবেগ নিয়ে \(a\) ত্বরণে \(t\) সময় ধরে চলে \(v\) বেগ প্রাপ্ত হয়। ত্বরণের সমীকরণ থেকে আমরা পাই:
$$v = u + at$$
২. বস্তুর সরণ: সরণ \(s\) এর সমীকরণ হলো:
$$s = ut + \frac{1}{2}at^2$$
৩. গতিশক্তির সমীকরণ: আমরা জানি, কাজ (Work) হলো শক্তির রূপান্তর। কাজের সমীকরণ হলো:
$$W = F \cdot s$$
এখানে, \(F\) হলো বল এবং \(s\) হলো সরণ। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী, \(F = ma\)। সুতরাং,
$$W = ma \cdot s$$
সরণের সমীকরণ থেকে \(s\) এর মান বসিয়ে পাই:
$$W = ma \cdot \left(ut + \frac{1}{2}at^2\right)$$
আদিবেগ \(u = 0\) হলে, সমীকরণটি দাঁড়ায়:
$$W = ma \cdot \frac{1}{2}at^2$$
$$W = \frac{1}{2}m(at^2)$$
আবার, \(v = at\) হলে,
$$W = \frac{1}{2}mv^2$$
সুতরাং, কাজের সমীকরণ থেকে আমরা পাই:
$$E_k = \frac{1}{2}mv^2$$
বিভব শক্তি ও বিভব শক্তির সমীকরণ প্রতিপাদন
বিভব শক্তি:
বিভব শক্তি \(E_p\) কে সংজ্ঞায়িত করা হয় একটি বস্তুর ভর \(m\), মহাকর্ষীয় ত্বরণ \(g\) এবং উচ্চতা \(h\) এর মাধ্যমে। এর সমীকরণটি হলো:
$$E_p = mgh$$
বিভব শক্তির সমীকরণ প্রতিপাদন:
১. মহাকর্ষীয় বল: মনে করি, একটি বস্তু ভর \(m\) নিয়ে উচ্চতা \(h\) পর্যন্ত উঠানো হয়েছে। মহাকর্ষীয় বলের কারণে বস্তুর উপর কাজ করা হয়:
$$F = mg$$
২. কাজ: কাজের সমীকরণ হলো:
$$W = F \cdot h$$
৩. বিভব শক্তির সমীকরণ: মহাকর্ষীয় বলের মান \(F = mg\) বসিয়ে পাই:
$$W = mg \cdot h$$
সুতরাং, কাজের সমীকরণ থেকে আমরা পাই:
$$E_p = mgh$$
নিচের উদ্দীপকটি পড়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও
0.5 kg ভরের একটি বস্তুকে 88 ms-1 বেগে খাড়া উপরের দিকে ছোড়া হলো। এটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠে আবার পড়ন্ত বস্তুর ন্যায় মুক্তভাবে ভূমিতে পতিত হলো।
ক. শক্তির রূপান্তর কী?
খ. গতিশক্তি ও ভরবেগের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন কর।
গ. বস্তুটি ছুড়ে মারার 3s পর গতিশক্তি কত হবে?
ঘ. দেখাও যে, ভূমি হতে 40 মিটার উপরে বস্তুটির যান্ত্রিক শক্তি ভূমিকে স্পর্শ করার মুহূর্তের গতিশক্তির সমান।
উদ্দীপক অনুসারে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হলো:
ক. শক্তির রূপান্তর কী?
শক্তির রূপান্তর বলতে বোঝায় এক ধরনের শক্তি থেকে অন্য ধরনের শক্তিতে পরিবর্তন। উদাহরণস্বরূপ, যখন একটি বস্তু উপরের দিকে ছোড়া হয়, তখন তার গতিশক্তি বিভব শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আবার যখন বস্তুটি নিচে পড়ে, তখন বিভব শক্তি পুনরায় গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
খ. গতিশক্তি ও ভরবেগের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন কর।
গতিশক্তি (K.E) এবং ভরবেগ (P) এর মধ্যে সম্পর্ক হলো: \[ \text{K.E} =
\frac{P^2}{2m} \] এখানে,
\( \text{K.E} \) = গতিশক্তি
\( P \) = ভরবেগ
\( m \) = ভর আমরা জানি, \[ \text{K.E} = \frac{1}{2}mv^2 \] এবং \[ P = mv \]
তাহলে, \[ \text{K.E} = \frac{(mv)^2}{2m} = \frac{P^2}{2m} \]
গ. বস্তুটি ছুড়ে মারার 3s পর গতিশক্তি কত হবে?
বস্তুটি ছুড়ে মারার 3 সেকেন্ড পর তার গতিশক্তি নির্ণয় করতে হলে, প্রথমে তার বেগ
নির্ণয় করতে হবে।
ধরা যাক, অভিকর্ষজ ত্বরণ \( g = 9.8 \, \text{m/s}^2 \)।
বস্তুটির প্রাথমিক বেগ \( u = 88 \, \text{m/s} \)।
\[ v = u - gt \] \[ v = 88 - 9.8 \times 3 \] \[ v = 88 - 29.4 \] \[ v = 58.6
\, \text{m/s} \] তাহলে, \[ \text{K.E} = \frac{1}{2}mv^2 \] \[ \text{K.E} =
\frac{1}{2} \times 0.5 \times (58.6)^2 \] \[ \text{K.E} = 0.25 \times 3432.36
\] \[ \text{K.E} = 858.09 \, \text{J} \]
ঘ. দেখাও যে, ভূমি হতে 40 মিটার উপরে বস্তুটির যান্ত্রিক শক্তি ভূমিকে স্পর্শ করার মুহূর্তের গতিশক্তির সমান।
বস্তুটির যান্ত্রিক শক্তি (মোট শক্তি) হলো বিভব শক্তি (P.E) এবং গতিশক্তির (K.E) যোগফল। ভূমি থেকে 40 মিটার উপরে বিভব শক্তি: \[ \text{P.E} = mgh \] \[ \text{P.E} = 0.5 \times 9.8 \times 40 \] \[ \text{P.E} = 196 \, \text{J} \] ভূমি থেকে 40 মিটার উপরে গতিশক্তি: \[ v^2 = u^2 - 2gh \] \[ v^2 = 88^2 - 2 \times 9.8 \times 40 \] \[ v^2 = 7744 - 784 \] \[ v^2 = 6960 \] \[ v = \sqrt{6960} \] \[ v \approx 83.4 \, \text{m/s} \] তাহলে, \[ \text{K.E} = \frac{1}{2}mv^2 \] \[ \text{K.E} = \frac{1}{2} \times 0.5 \times (83.4)^2 \] \[ \text{K.E} = 0.25 \times 6960 \] \[ \text{K.E} = 1740 \, \text{J} \] তাহলে, ভূমি থেকে 40 মিটার উপরে বস্তুটির মোট যান্ত্রিক শক্তি: \[ \text{E} = \text{P.E} + \text{K.E} \] \[ \text{E} = 196 + 1740 \] \[ \text{E} = 1936 \, \text{J} \] ভূমিতে স্পর্শ করার মুহূর্তে বস্তুটির গতিশক্তি: \[ \text{K.E} = \frac{1}{2}mv^2 \] \[ \text{K.E} = \frac{1}{2} \times 0.5 \times (88)^2 \] \[ \text{K.E} = 0.25 \times 7744 \] \[ \text{K.E} = 1936 \, \text{J} \]
তাহলে, ভূমি হতে 40 মিটার উপরে বস্তুটির যান্ত্রিক শক্তি ভূমিকে স্পর্শ করার মুহূর্তের গতিশক্তির সমান।
শক্তির রূপান্তর ও সংরক্ষণশীলতার নীতি বিজ্ঞানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই নীতির ভিত্তিতে গতিশক্তি ও বিভব শক্তির সমীকরণ প্রণয়ন করা হয়েছে, যা প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয়। এ সংক্রান্ত সৃজনশীল প্রশ্নের সমাধান আমাদের বিজ্ঞান সচেতনতা বৃদ্ধি করে।